‘আমার কাজ মানুষ ভালোভাবে নিয়েছে। অভিনন্দন দেয়, উৎসাহ দেয়। ফেইসবুকেও খুব একটা খারাপ মন্তব্য পাই না।’
Published : 03 Jul 2025, 05:06 PM
পাহাড়িদের জীবনাচারণ ও তাদের নানা লড়াই-সংগ্রামের গল্প আঁকা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরে অনেকের কাছেই পরিচিতি পেয়েছেন তুফান চাকমা। জাতিসংঘের সম্মাননাও পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এই তরুণ। গেল মাসে ফ্রান্সে তার একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ও নিজ জীবনের নানা গল্প নিয়ে তিনি কথা বলেছেন হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।
হ্যালো: প্রথমেই জানতে চাই, আপনার আঁকাআঁকির শুরুর দিকটা কেমন ছিল?
তুফান চাকমা: আমার বড় হওয়া, প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের পুরো সময়টাই কেটেছে গ্রামে। ছবি আঁকা শেখার সুযোগ বা পরিবেশ ছিল না। বাবা-মা মূলত পড়াশোনার দিকেই জোর দিতেন। তবে ছবি আঁকার বিষয়ে তারা আমাকে নিরুৎসাহিতও করেননি। আসলে ছবি এঁকে যে ক্যারিয়ার গড়া যায়, এটা তারা বুঝতেন না। আমার বন্ধুরা আমার আঁকা ছবি দেখে উৎসাহ দিত। তারাই চাইত আমি আঁকাআঁকি চালিয়ে যাই।
হ্যালো: বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আপনি চারুকলা অনুষদে পড়েছেন। শৈশবেই কি ঠিক করে রেখেছিলেন বড় হয়ে কী হবেন বা কী নিয়ে পড়বেন?
তুফান চাকমা: ছোটবেলায় চারুকলা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। শুধু নিজের মত করে আঁকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে একটু একটু করে জানতাম, আর ভর্তি হওয়ার পর থেকে চারুকলা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে শেখা শুরু করি। ছোটবেলা থেকেই আমার আঁকার হাত ভালো ছিল। ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ থেকেই চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। নিজে নিজে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কারও দিকনির্দেশনা পাইনি। তবে ফলাফলে দেখি, আমি ষষ্ঠ হয়েছি!
হ্যালো: চিত্রশিল্পী হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?
তুফান চাকমা: অর্থনৈতিক দিকটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কারণ, আমার পরিবার খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি পাঁচ বছর টিউশন করেছি। তবে অন্য দিক দিয়ে আমি বরং অনেক সৌভাগ্যবান। আমার কাজ মানুষ ভালোভাবে নিয়েছে। অভিনন্দন দেয়, উৎসাহ দেয়। ফেইসবুকেও খুব একটা খারাপ মন্তব্য পাই না। আর পেলেও আমি সেগুলোকে প্রতিবন্ধকতা মনে করি না, কারণ আমি জানি আমি কী করছি এবং কীভাবে সংগ্রাম করছি।
হ্যালো: অনেকেই বলে আপনার আঁকা ছবিগুলো সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। আপনার কি এমনটাই লক্ষ্য ছিল?
তুফান চাকমা: আমি ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম সমাজ বদলাব এমন উদ্দেশে না। আমি শুধু চেয়েছিলাম পাহাড়িদের জীবন, তাদের না-বলা কথা, অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয় ছবির মাধ্যমে জানাতে। কারও মন বা ধারণা যদি বদলায়, সেটা দারুণ ব্যাপার।
হ্যালো: আপনি বর্তমানে কী করছেন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন?
তুফান চাকমা: আমি ২০২৪ সালে ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ পাই। এখন ফিনল্যান্ডে আছি। এই দুটো বছর আমার জীবনে ছিল নতুন নতুন প্রাপ্তি আর ব্যস্ততার সময়। ভবিষ্যতে আমার লক্ষ্য, এই পড়াশোনা ভালোভাবে শেষ করা এবং যদি আর্থিক সহায়তা পাই, তাহলে ভালো ভালো প্রকল্পে কাজ করতে চাই। আর আঁকাআঁকি তো চলবেই।
হ্যালো: সবশেষে ফ্রান্সের প্রদর্শনী সম্পর্কে জানতে চাই। কেমন ছিল সেটা?
তুফান চাকমা: ফ্রান্সে আদিবাসীদের সংগঠন ‘লা ভোয়া দে জু্ম্ম’ এর পক্ষ থেকে আমাকে একটি একক প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়। বাংলাদেশে থাকতেই এমন প্রস্তাব পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল আমি প্রস্তুত না। বলেছিলাম ছবি এঁকে ফিনল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে পাঠানো সম্ভব না। কিন্তু তারা বলল, ডিজিটাল আর্ট হলেই হবে। একাডেমিক চাপের মাঝেই ২০ থেকে ২৫টা ছবি নতুন করে এঁকে ফেললাম। দুই দিনব্যাপী প্রদর্শনী হল। যার শিরোনাম ছিল ’পাহাড়ের ঘুমপাড়ানি গান’। প্রদর্শনীতে চাকমা রানি ইয়েন ইয়েনও উপস্থিত ছিলেন। দর্শনার্থীরা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, অনেকে ছবি নিয়েও গেছেন।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৭। জেলা: খাগড়াছড়ি।