রাস্তায় এসে দেখি মানুষ শুধু ভিডিও করছে, কেউ সাহায্য করছে না।
Published : 23 Jul 2025, 09:14 PM
আমি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রতিদিনের মত সোমবারও আমাদের ছুটি হয় দুপুর ১টায়। তবে কোচিং ক্লাস থাকায় আমরা সাত থেকে আটজন ছিলাম, বাকিরা চলে গিয়েছিল।
ছুটির কিছুক্ষণ পরই আমাদের ক্লাসে আসেন মিস। তখন তার ফোনে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছিল, খুব সম্ভবত তিনি কল করতে পারছিলেন না।
আমি সামনের বেঞ্চে ছিলাম বলে মিস আমাকে বললেন, 'হৃদিকা বাবা, দেখ তো, কাজ করতে পারছি না।'
আমি উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিই, ঠিক তখনই বিকট এক শব্দ হয়। মনে করেছিলাম, কোনো ভবন ভেঙে পড়েছে। কারণ আশপাশে নির্মাণকাজ চলছিল। কিন্তু শব্দটা এতটাই তীব্র ছিল যে আমরা জানালার দিকে দৌড় দিই। গিয়ে দেখি হায়দার আলী ভবনে আগুন আর কালো ধোঁয়া!
আমাদের কলেজ ভবনের সামনে একটা বড় মাঠ আছে। মাঠের পরেই জুনিয়র সেকশন, যেটা পড়েছে হায়দার আলী ভবনে। সেখানেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
জানালা দিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মিস চিৎকার করে উঠলেন, 'আল্লাহ, আমার মেয়ে ওখানে'।
আমরা যে যেভাবে ছিলাম ছুটে বেরিয়ে যাই। আমরা ছিলাম ছয় তলায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে অনেক সময় লেগে যায়। নিচে পৌঁছালে শিক্ষকরা বলেন, 'উত্তেজিত হয়ো না, শান্ত হও।' আগুন আর ধোঁয়ার দিকে যেতে আমাদের নিষেধ করা হয়।
আমার শ্বাসকষ্ট আছে, সঙ্গে 'অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার' বা উদ্বেগজনিত সমস্যাও আছে। তখনই আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। মাথায় ঘুরছিল, যদি আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, কে আমাকে বাসায় পৌঁছাবে? আমি দৌড়ে ইনহেলার নিতে নিতে ক্যাম্পাস থেকে বের হই।
রাস্তায় এসে দেখি মানুষ শুধু ভিডিও করছে, কেউ সাহায্য করছে না। কোনোমতে রিকশায় উঠলাম, চলন্ত রিকশায় হাতেও ব্যথা পেলাম।
বাসায় পৌঁছে দারোয়ান আঙ্কেলকে বলি, 'আঙ্কেল, উপরে কল দেন, আমাকে একটু নিতে বলেন।'
এরপর শরীর আর নড়ছিল না। এক হাতে গেট ধরে রেখেছি, অন্য হাতের আঙুল বেঁকে গিয়েছিল, নাড়াতেও পারছিলাম না। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না, বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। আমি নিজেই ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমি কি প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছি?
উপর থেকে একজন এসে আমাকে বাসায় নিয়ে যায়। বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, তখন কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসে।
তখন কিছুটা সুস্থ বোধ করি, তবে হাত-পা তখনও কাঁপছিল। আমি শুধু কাঁদছিলাম। মনে হচ্ছিল, ঘটনাস্থলে থেকেও কিছু করতে পারিনি। আমি যদি অসুস্থ না হতাম, নিশ্চয়ই কিছু করতে পারতাম।
ভাবছিলাম, যদি বিমানটি বাচ্চাদের ভবনে না পড়ে, বড় মাঠে পড়ত, তাহলে হয়ত এত প্রাণহানি হত না। এসব ভেবে আবার বুকের ব্যথা শুরু হয়।
এদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি, ছোট ছোট শিশুদের কথা ভেবে কান্না থামছিল না। যদি কলেজ থেকে বের হতে দেরি হত, হয়ত আমি সেখানেই পড়ে যেতাম। বাবা-মা তো এখানে থাকেন না, তাহলে আমাকে কে খুঁজতে যেত?
এই শোক, এই ব্যথা, কোনোদিন ভুলে থাকতে পারব না। পরবর্তীতে যখন কলেজে যাব, সেই রাস্তার সামনে দিয়ে কীভাবে যাব? দিন শেষে এই না পারার যন্ত্রণা, কিছু না করতে পারার আফসোস সারা জীবন বুকের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধে থাকবে।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৭। জেলা: ঢাকা।