বই-খাতা নিয়ে মগ্ন থাকার এ বয়সে কেন তাদের সংসারের হাল ধরার বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে?
Published : 01 Sep 2025, 01:24 PM
স্কুল আর বই-খাতার সঙ্গে সখ্যতার বয়সে প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে ছুটতে হয় অনেক শিশুকেই। স্কুল, পড়াশোনা আর সহপাঠীদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোর ফেলে সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে হচ্ছে তাদের।
সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’-এ বলা হয়েছে, দেশে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ শিশুশ্রমিক আছে। শিশুশ্রম নিয়ে এটিই বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ। যেখানে আরও বলা হয়, গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৭৭ হাজার বেড়েছে।
বই-খাতা নিয়ে মগ্ন থাকার এ বয়সে কেন তাদের সংসারের হাল ধরার বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে কথা হয়েছে গাজীপুরের একটি পোশাকের দোকানে কাজ করা সুমন নামের এক কিশোরের সাথে। সে জানাল, প্রাথমিকের গণ্ডি পার হলেও মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করতে পারেনি।
অষ্টম শ্রেণিতে ঝরে পড়া সুমন হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, তার বাবা গ্রামে রিকশা চালান। পাঁচ সদস্যের সংসারে সচ্ছলতা আনতে স্থানীয় এক পরিচিতের দোকানে তাকে কাজে দেওয়া হয়।
সুমনের ভাষায়, “পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারতেছিলাম না, তাছাড়া বাড়িতেও টানাপোড়েনের সংসার। প্রথমে কাজ করতে চাইনি, কিন্তু এসব চিন্তা করে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছি।”
সে আরও বলে, “এখন মনে হয় তখন পড়লে কলেজে থাকতাম। স্কুলের সহপাঠীরা অনেকে ভালো জায়গায় পড়ছে। আমাকে তো সারাজীবনই এসব কাজ করে যেতে হবে।”
সুমনের মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। তিনি জানালেন, ছেলেকে অন্তত কলেজ পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হেরে যেতে হয়েছে।
সুমনের মত এক রকম বাধ্য হয়েই পড়াশোনা ছাড়তে হয় অনেক শিশুকেই।
রাজধানীতে কথা হয় ১৩ বছরের কিশোর সোহাগের সঙ্গে। সে উত্তর বাড্ডার একটি রেস্তোরাঁয় দিনে দুই শিফটে প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করে।
পরিবারে অর্থের জোগান দিতে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নামতে হয়েছে তাকে। তবে এখন আর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নেই। সুযোগ দিলেও স্কুলে ফিরতে রাজি নয় বলে জানায় সে।
১২ বছরের নাজমুলও একই কারণে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নেমেছে। বাড্ডার তেঁতুলতলা এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় সারাদিন কাজ করে মাসে ছয় হাজার টাকা আয় করে সে।
পড়াশোনা প্রসঙ্গে নাজমুল হ্যালোকে বলে, “পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও বাবা-মা কাজে পাঠাইছে। সুযোগ দিলেও পড়তে চাই না, এখন তো বয়সও নাই।”
লিমন নামের আরেক শিশুশ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় বাড্ডা এলাকাতেই। তার বয়স ১৩। তৃতীয় শ্রেণিতেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে সে।
বর্তমানে বাবা ও তার আয়ে সংসার চলে। তবে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় মন খারাপ হয় লিমনের। সহায়তা পেলে আবার স্কুলে ফিরতে চায় বলে জানায় সে।
বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ আদিল হাসান চৌধুরী।
বাংলাদেশে শিশুদের শ্রমে ঝুঁকে পড়ার পেছনে মূল কারণ দুটি বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, "সাধারণত বাংলাদেশে শিশুরা দুটি কারণে শ্রমে ঝুঁকে পড়ে। প্রথমত, পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য একজন শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল শিশুর বিদ্যালয়ে না যাওয়ার পেছনে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ প্রভাব ফেলে। একজন শিশু যেভাবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেটি আরেকটি বড় কারণ।
"শিশুদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের স্কুলমুখী করতে হবে। বাংলাদেশের একটি সমস্যা হল শিক্ষাব্যবস্থা। যার ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এছাড়াও শিশুশ্রমের নামে অনেকে দেখা যায় ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যালয় যায় না।"
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ শ্রম আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ। তবে ১২ বছর পূর্ণ হলে কেবল হালকা ও নিরাপদ কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। শর্ত হচ্ছে যেন তা তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট না করে এবং পড়াশোনায় বাধা না দেয়।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: ঢাকা।