‘আমি সবাইকে একটা বার্তা দেব, আপনি আপনার সন্তানদের দুই ভাগে ভাগ করবেন না। ছেলে সন্তানও আপনার, মেয়ে সন্তানও আপনার। এখন কিন্তু আর সেই দিন নেই, পরিবর্তন হয়েছে। এখন মেয়েরাও বংশের প্রদীপ, শুধু ছেলেরা নয়।’
Published : 07 Apr 2024, 06:34 PM
সাতক্ষীরার বাঁকাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা চন্দনা বোস। ছোট বেলায় বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় স্বজন ও প্রতিবেশীদের কটু কথা শুনতে হয় তাকে। তার পরিবারকে প্রায় এক ঘরে করে দেওয়ার মতো অবস্থারও সৃষ্টি হয়। এমন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বড় হওয়া এই নারী পারিবারিক জীবনে এখন এক কন্যা সন্তানের জননী। একজন শিক্ষিকা ও অভিভাবক হিসেবে তিনি সোচ্চার বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে। বাল্যবিয়ের ক্ষতি ও বাল্যবিয়ে বন্ধে করণীয় নিয়ে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
হ্যালো: আপনার কন্যা সন্তান রয়েছে। তাকে নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
অভিভাবক: আমার মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি একজন শিক্ষিকা হিসেবে অন্য শিশুদের স্বপ্ন তৈরি করছি। তাহলে কেন আমি নিজের মেয়ের স্বপ্নটাকে ভঙ্গ করব?
হ্যালো: বাল্যবিয়ে রোধে আপনি কী পরামর্শ দিবেন?
অভিভাবক: বিশ্বায়নের এই যুগে বাল্যবিয়ের মতো ঘটনা আমাদের জন্য হতাশাজনক। আমি মনে করি, এই যুগে বাল্যবিয়ে দেওয়াটা মধ্যযুগে বাস করার মতো। এখন তো আমরা মধ্যযুগে বাস করি না।
এই বিশ্বায়নের যুগে মেয়েরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। বুয়েট, মেডিকেলসহ সকল স্থানে মেয়েরা তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার পরিচয় দিচ্ছে। মেয়েরা যে আসলে পিছিয়ে নেই এটা তারা প্রমাণ করেছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা কঠিন নয়, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা কঠিন। এই প্রতিকূলতার জায়গা থেকে উঠে এসে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে।
এই যে আমরা মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছি, বাল্যবিয়ে দেওয়ার পর তাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিতে না পারার ব্যর্থতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। আমি সবাইকে একটা বার্তা দেব, আপনি আপনার সন্তানদের দুই ভাগে ভাগ করবেন না। ছেলে সন্তানও আপনার, মেয়ে সন্তানও আপনার। এখন কিন্তু আর সেই দিন নেই, পরিবর্তন হয়েছে। এখন মেয়েরাও বংশের প্রদীপ, শুধু ছেলেরা নয়।
সমাজকে বলব আপনার চিন্তা চেতনাকে পরিবর্তন করেন। আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন না করি তাহলে আমরা সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়তে পারব না। মেয়েদের সুস্থ জীবন ও সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারব না। আমরা সেই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসি, যে চিন্তা একটি ছেলেকে ও মেয়েকে আলাদা করে।
আমি একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলতে পারি। আমার ফুপাতো ভাই যখন বিয়ে করে তখন তার স্ত্রী সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়েটির বাড়িতে কিছু অসুবিধার কারণে তাকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। অপরাধ তাদেরও, আমাদেরও। বিয়ের ছয় বছর পর আমার ফুপাতো ভাই মারা যায়। এখন আমার ভাইয়ের স্ত্রীর ভবিষ্যৎ কী? তার দুই সন্তান। সমাজ এখন এর কী সমাধান দিবে?
এই মেয়েটা, যার এখন রঙিন স্বপ্ন দেখার কথা, সে এখন অন্ধকার দুঃখের সাগরে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
হ্যালো: মেয়েকে বাল্যবিয়ে না দেওয়ার জন্য কখনো কি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হয়েছে?
অভিভাবক: আমার মেয়ে এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। তবে আমার ক্ষেত্রে, আমি ও আমার আরও দুই বোন বাল্যবিয়ে না করায় শুধু প্রতিবেশী নয় আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকেও কটু কথা শুনেছি। এমনকি এক ঘরে করে দেওয়ার মত পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে আমি বড় হয়েছি।
আমি সবাইকে বলব, আপনি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে শিখুন। আপনার সন্তানকেও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে শেখান। প্রতিকূলতা ছিল, আছে ও থাকবে। এটাকে মানিয়ে নিতে হবে, জয় করতে হবে।
হ্যালো: আপনার মেয়েকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান?
অভিভাবক: আমি অবশ্যই আমার মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। তবে পেশাগত জীবন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি তার উপর কোন চাপ প্রয়োগ করব না। তবে সে বিজ্ঞানী হতে চায়। আমি চাই, তার স্বপ্ন পূরণ হোক। আমি আমার মেয়েকে সাহস দেব ও সহযোগিতা করব। আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে প্রতি ক্লাসে একটা বার্তা দেই, স্বপ্ন দেখতে না শিখলে স্বপ্ন পূরণ করা যায় না।
হ্যালো: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অভিভাবক: ধন্যবাদ, তোমাকেও।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৪। জেলা: সাতক্ষীরা।