আমি জানি, আমার মা হয়ত কখনোই আমার এই লেখাটা পড়বেন না, তবুও এই লেখার মাধ্যমে মাকে ভালোবাসি কথাটা জানাতে চাই।
Published : 11 May 2025, 05:53 PM
আমার মা ১৯৭৩ সালে শরীয়তপুরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান তিনি।
ছোট থাকায় সবার কাছে তিনি বেশ আদরের ছিলেন। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ এক বড় পরিবারে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু যখন তিনি মাত্র তিন বছর বয়স, গ্রামে এক দুর্ঘটনায় মারা যান তার বাবা। মাটিতে লুটিয়ে পড়া বাবাকে তিন বছরের ছোট্ট শিশু আমার মা দেখেছিলেন। তবে হয়ত তখন তিনি বুঝতেই পারেননি যে তিনি আসলে কী হারিয়েছেন।
আম্মুর বয়স যখন ১৩, শরীয়তপুরের আরেকটি গ্রাম থেকে এক পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসে। পরিবারের জোরাজুরি ছিল, আর ১৩ বছর বয়সী আমার সেই শিশু মা বাধ্য হয়েছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে।
শ্বশুরবাড়িতে এসে তিনি বুঝতে পারেন এটি একটি নতুন পরিবেশ, যেখানে সব মুখ অচেনা এবং কাজের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু ছোট বয়সে সেসব দায়িত্ব তিনি একা নিজের কাঁধে তুলে নেন।
আমি ১৫ বছর বয়সে যখন পাঁচ ঘণ্টা স্কুলে থেকে বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, তখন ১৫ বছর বয়সেই আমার মা কোলে নিয়ে বড় করছেন আমার বোনকে। এর এক বছর পর আমাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে।
মা তার দ্বিতীয় সন্তানের মা হন ১৭ বছর বয়সে। দুটি সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ভাসুর এবং প্রবাসী স্বামীকে ভালো রাখার দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নেন। পরিবারের এই বিশাল দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে মা কখনো থেমে যাননি।
মা ২১ বছর বয়সে আবার সন্তানের মুখ দেখেন। এরপর ছোট দুই ছেলেসহ মা একে একে পাড়ি জমিয়েছেন বহু দেশে। ভারত, আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং আবার ফিরে এসেছেন তার নিজ মাতৃভূমিতে।
প্রায় ৮ বছর পর, আমার জন্ম হয়। আজ আমার বয়স প্রায় ১৭ বছর। এতগুলো বছর পর যখন আমি আমার মায়ের চোখের দিকে তাকাই, তখন আমি দেখতে পাই সেই ছোট্ট শিশুটিকে, যে বাঁচতে চেয়েছিল, তার স্বপ্নগুলো আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল, যে উড়তে চেয়েছিল খোলা আকাশে পাখির মত।
আমি যখনই নিজেকে আমার মায়ের অবস্থানে বসাতে চাই, তখনই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয়, আমার জন্যই হয়ত সে তার স্বপ্নগুলো পূর্ণ করতে পারেনি, তার দিনগুলো নিজের মত করে কাটাতে পারেনি। আমি আমার মায়ের চোখে দেখতে পারি কীভাবে তিনি তার স্বপ্নগুলোকে আমার মধ্য দিয়ে পূর্ণ করতে চান। তিনি চান, আমি তার অসম্পূর্ণ গল্পটিকে পূরণ করি।
ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত অগণিতবার আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরেছি, কিন্তু কোনো দিনও তাকে বলিনি আমার মায়ের কষ্টগুলো আমি অনুভব করতে পারি। কখনোই তাকে বলতে পারিনি যে, আমি তাকে কতটা ভালোবাসি, আমি তাকে কীভাবে দেখি।
আজ আমার চোখে হাজারটা স্বপ্ন দেখি। তবে সেই স্বপ্নের প্রথমেই রয়েছে আমার মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করা। তাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দেওয়া, যেগুলো পাওয়ার ছিল তার অধিকার।
আমি জানি, আমার মা হয়ত কখনোই আমার এই লেখাটা পড়বেন না, তবুও এই লেখার মাধ্যমে মাকে ভালোবাসি কথাটা জানাতে চাই। মা, তোমার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। আর তোমাকে যে প্রতিদিন বিরক্ত করি, দুশ্চিন্তায় রাখি, তার জন্য আমি দুঃখিত। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
কিন্তু বিশ্বাস কর আমি যা কিছু করছি, তোমার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য করছি। কারণ তুমি সেই বিশেষ ব্যক্তি, যে বিশেষ কিছু পাওয়ার যোগ্য।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: ঢাকা।