ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে টানাপোড়েন কেন?

“অনেক বাবা মা সন্তানের অপরাধ সংশোধনের বদলে ঢাকার চেষ্টা করেন। যা তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।”
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে টানাপোড়েন কেন?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ জুড়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক আক্রান্ত হচ্ছেন; আবার শিক্ষকের হাতে ছাত্র-ছাত্রী নির্যাতনের খবরও আসছে হরহামেশা।

আমেরিকান জার্নাল অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, শিশুকালে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কই নির্ধারণ করে দেয় বড় হয়ে এই ছাত্রটি শিক্ষক বা সমাজের অন্যান্যদের সাথে কী আচরণ করবে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক ব্লগ পোস্টে বলা হয়েছে যে, শিশু বয়সে একজন শিক্ষার্থী যদি সামাজিক ও সহনশীল হওয়ার শিক্ষা পায় তবে তা পরবর্তীতে তার শিক্ষাগত অর্জন, কর্মসংস্থান, আয় প্রভৃতিতে ভূমিকা রাখে। এবং এই শিক্ষা তার ধ্বংসাত্মক আচরণকে প্রশমন করে।

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের পরিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কি শিশুদের সামাজিক মূল্যবোধ ও সহনশীল হওয়ার পাঠ দিতে পারছে না? নাকি এর সাথে যুক্ত রয়েছে আরো নানান কারণ?

বিষয়টি নিয়ে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলে শিক্ষক, মনোবিদ ও অভিভাবকদের সঙ্গে।

মানবর্ধন পাল একজন লেখক ও শিক্ষক। প্রায় ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন একটি বেসরকারি কলেজে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন যা ঘটছে তা ‘কলঙ্কজনক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকের পরিস্থিতির জন্য বর্তমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। তাছাড়া, অনৈতিক উপায়ে শিক্ষক ও শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়োগ, মন্ত্রণালয়ের মনিটরিংয়ের অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় এ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।”

এই লেখক মনে করেন যে, ছাত্র-ছাত্রীরা দিনের অধিকাংশ সময় পরিবারের সঙ্গে থাকে। তাই তাদের চরিত্র গঠনের মূল দায়িত্ব মা বাবার।

তিনি এই অবস্থা পরিবর্তনে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনসহ সামাজিক ও পারিবারিক উদ্যোগের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

আমেরিকার ওয়েস্টার্ন কানেক্টিকাট স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মনোজ মিশ্র হ্যালোকে বলেন, “সাধারণত উন্নত দেশ সমূহে ছাত্ররা শিক্ষককে একক বা সংঘবদ্ধভাবে অপমান করছে বা কেউ একজন শিক্ষককে মেরে ফেলছে এমন দেখা যায় না। ইদানিং বাংলাদেশে যা হচ্ছে তার অন্যতম কারণ পারিবারিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও আইনের প্রয়োগ না থাকা।”

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. ফারাহ দীবার কাছে জানতে চাইলে তিনি হ্যালোকে বলেন, “আজকের শিশু পরিণত বয়সে কেমন মানুষ হবে, বড় হয়ে নিজের বা সমাজে অন্যদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে তা নির্ভর করে শৈশবে অর্জিত শিক্ষার উপর।”

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “অভিভাবকরা সন্তানের শারীরিক বিকাশ নিয়ে ভাবেন। যেসব বাবা মা একটু এগিয়ে, তারা চিন্তা করেন সন্তানের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ নিয়ে। তবে, তাদের ভাবনাও সন্তান যেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা অর্জনে পারদর্শী হতে পারে সে পর্যন্ত।

“তবে খুব কম সংখ্যক বাবা মা শিশুদের মানবিক গুণাবলীর বিকাশের ও তাকে দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।”

শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর অনাকাঙ্খিত আচরণের কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, “বেশিরভাগ বাবা মা চান তার সন্তান যেন জয়ী হতে পারে। আর এ ধরনের শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই শিশুদের প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন করে তোলেন। আজকাল এই ধরনের মনোবৃত্তির কারণে শিশু-কিশোরদের দ্বারা নানা অপরাধ সংগঠিত হয়, যেসব অপরাধ এক বা দুই দশক আগেও ঘটতে দেখা যেত না।”

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করনে সোনিয়া হাসান। তিনি তিন সন্তানের মা। সন্তান ‘বখে’ যাওয়ার পেছনে পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি, বাবা মায়ের সঙ্গে দূরত্ব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নজরদারির অভাবকে মূল কারণ বলে মনে করেন তিনি।

সোনিয়া হ্যালোকে বলেন, “অনেক বাবা মা সন্তানের অপরাধ সংশোধনের বদলে ঢাকার চেষ্টা করেন। যা তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছন্দা কর্মকার হ্যালোর সঙ্গে এক কথোপকথনে ছাত্র-শিক্ষকের বর্তমান এই নাজুক সম্পর্কের জন্য পরিবার, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক, রাষ্ট্র সবাইকেই দায়ী করেন।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “মূলত শৈশবেই শিশুর মূল্যবোধ তৈরি হয়। অর্থাৎ ভালো-মন্দের শিক্ষাটা সে তার পরিবার থেকেই অর্জন করে। অনেক সময় বাবা-মা নিজের সন্তানের ভুল আচরণকে ভুল হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। আবার, অনেক বাবা-মা অতি স্নেহে সন্তানের সব আবদার পূরণ করেন। যা পরবর্তীতে তাদের ধ্বংসাত্মক হতে শেখায়।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্যারেন্ট মিটিংয়ের ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেখানে শিক্ষক এবং বাবা-মায়ের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন হয়। শিক্ষক যদি কোনো ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন, তবে সেটা নিয়ে তার বাবা- মার সঙ্গে আলোচনার করবেন।”

তার মতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী থাকা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “এই ছাত্ররাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাই এদের সুস্থ্য ও সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব।”

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com