কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘোষণা করা হল, ‘এমআইআইসিএ স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড গোস টু রিভারগার্ড, বাংলাদেশ’।
Published : 09 Oct 2025, 09:10 PM
আমি ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের দশম শ্রেণিতে পড়ছি। স্কুলজীবন শেষ হওয়ার আগেই আমার জীবনে এমন একটি অর্জন এসেছে, যা স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আমি ও আমার দল অংশ নিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড ইনভেনশন কম্পিটিশন অ্যান্ড এক্সিবিশন (ডব্লিআইসিই) নামের একটি ইভেন্টে। এটি আয়োজন করে ইন্দোনেশিয়া ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইওয়াইএসএ), আর সহযোগিতা করে মালয়েশিয়ার সেগি ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ।
সেখানে আমাদের উদ্ভাবনী প্রকল্প ‘রিভারগার্ড’ স্বর্ণপদক জিতেছে। ‘রিভারগার্ড’ মূলত একটি প্রযুক্তি, যা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য রোধে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এই প্রকল্পে আমি ছিলাম দলনেতা। আমার সহযোদ্ধা ছিল সাবরিন মাহমুদ ইথান, আবরার সাদিক রাহা ও মোহাম্মদ তওসিফ আহনাফ। তাদের ছাড়া এই কাজ সম্ভব হত না। আমরা সবাই নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েছিলাম।
প্রকল্পটি করার সময় পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা দিন-রাত কাজ করেছি। তখনও জানতাম না আমাদের এই প্রচেষ্টা এত দূর যাবে। কিন্তু যখন জানতে পারলাম আমরা পুরস্কার পেতে যাচ্ছি, তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। নিজের কাজের স্বীকৃতি পাওয়া সত্যিই খুব আনন্দের।
সব প্রস্তুতি শেষ করে আমরা ২০ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা ত্যাগ করি। দুইবার ফ্লাইট বিলম্বের পর মালয়েশিয়ায় পৌঁছাই সকাল ৭টার দিকে। পৌঁছে ২০ রিঙ্গিত খরচ করে সিম কার্ড কিনে প্রথমেই মাকে ফোন দিই।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই। আমরা এতটাই উৎফুল্ল ছিলাম যে, ক্লান্তি যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। এরপর বাংলাদেশিদের পরিচালিত একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, বিদেশেও যেন দেশের ছোঁয়া আছে।
সেদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও, আমরা চারজন বন্ধু বেরিয়ে পড়ি শহর দেখতে। প্রায় সাত কিলোমিটার হেঁটে ফেলি আমরা! রাজধানী শহর কুয়ালালামপুরের রাস্তায় রঙিন আলো, লাইভ মিউজিক আর খাবারের গন্ধ ভরা পরিবেশ যেন রূপকথার মত লাগছিল।
পরের দিন সকালে আমরা যোগ দিই সেই কাঙ্ক্ষিত আয়োজনে, সেগি ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে আমি ১০ মিনিটের একটি প্রেজেন্টেশন দিই আমাদের প্রকল্প নিয়ে। বিচারকরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমার বলা শেষ হওয়ার পর একজন বিচারক নিজের ভিজিটিং কার্ড দিলেন, আরেকজন ছবি তুললেন আমার সঙ্গে। তখন মনে হচ্ছিল আমাদের পরিশ্রম সত্যিই সার্থক হয়েছে।
এরপরের দিন ছিল সাংস্কৃতিক ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সেখানে আমরা বাংলাদেশি একটি সিনেমার গান গেয়েছিলাম। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন এক বৈশ্বিক পরিবারের অংশ। অন্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে পেরেছি এখান থেকে।
সবশেষে এল পুরস্কার ঘোষণার সময়। তখন নিঃশ্বাস যেন আটকে গিয়েছিল। মাইকে ঘোষক বললেন, 'গোল্ড মেডেল- রিভারগার্ড, বাংলাদেশ।' এটা শুনে আমরা চিৎকার করে উঠি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘোষণা করা হল, ‘এমআইআইসিএ স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড গোস টু রিভারগার্ড, বাংলাদেশ।’
আমরা তখন আনন্দে অভিভূত! হাতে দুটি পুরস্কার, আর বুকভরা গর্ব। আমরা লাল-সবুজের পতাকা উঁচু করে উড়াতে থাকলাম। ছবি তুললাম, গান গাইলাম, হাসলাম। সবমিলিয়ে সেই দিনটা আমাদের জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
মালয়েশিয়ায় সাত দিন কাটানোর পর ২৭ তারিখ আমরা দেশে ফিরি। ভোরে বাসায় আসার পর দেখি পরিবারের সবাই ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে স্বাগত জানাতে। যে দৃশ্য কখনও ভোলার মত নয়।
পরদিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করলাম, তারা শুনে খুব খুশি হলেন। আমাদের এই অর্জনের খবর শিক্ষক, বন্ধু, স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ রইল না। গোটা দেশের মানুষও জেনে গেল এই খবরটি। কারণ বিভিন্ন গণমাধ্যম আমাদের নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সবশেষে এটাই বলতে চাই, এই যাত্রা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি বুঝেছি অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস, দলগত কাজ আর সময় ব্যবস্থাপনা কত গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে আমি একজন প্রকৌশলী হতে চাই। আমার লক্ষ্য শুধু পুরস্কার জেতা নয়, আমি এমন কিছু তৈরি করতে চাই যা সত্যিকার অর্থে আমার দেশে পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: ঢাকা।