বাসিন্দাদের মতে, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই জলবায়ু শরণার্থী।
Published : 08 Oct 2025, 10:05 PM
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও উন্নয়ন সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্ব হওয়া অনেক মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার বস্তিগুলো। দিন দিন এই সংখ্যা আরও বাড়ছে।
এই জলবায়ু শরণার্থীদের জীবন কাছ থেকে জানার আগ্রহ থেকে আমি বাবাকে নিয়ে গেলাম ঢাকার কড়াইল বস্তিতে। এটি আয়তনের দিক থেকে এই শহরের সবচেয়ে বড় বস্তি। মহাখালী এবং অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকার পাশে এর অবস্থান।
গুলশান লেক পেরিয়ে নৌকায় কড়াইলে ঢুকলাম। মাঝির কাছ থেকে জানলাম, বস্তির দুটি প্রধান অংশের নাম জামাই বাজার ও বউ বাজার।
নৌকা থেকে নামার পর দেখা হল মুজিবুর নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানালেন, শৈশবে নদীভাঙনে তাদের বসতভিটা হারিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। এখানে আসার পর তাদের জীবন ছিল খুব কষ্টের, আর সেখানেই থেমে যায় তার পড়াশোনা।
কথা বলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বস্তির ভেতর দিকে। ঘুরে দেখলাম ঘিঞ্জি ঘর আর নোংরা পরিবেশে কীভাবে মানুষ বেঁচে আছে। কোনো কোনো ঘর এত ছোট যে শুধু একটা খাট রাখলেই জায়গা ফুরিয়ে যায়। এখানকার শিশুরা এমন পরিবেশেই বড় হচ্ছে।
বাসিন্দাদের মতে, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই জলবায়ু শরণার্থী। বন্যা, নদী ভাঙন বা ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে তারা ঢাকায় এসেছে। কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করে, কেউ রিকশা চালায়, কেউবা গৃহকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে।
লিটন ফকির নামের এক ব্যক্তি জানালেন, তিনি বরিশালের বানারীপাড়া থেকে এসেছেন ২০ বছর আগে। নদীভাঙনে সব হারিয়ে তিনি এখন কড়াইলের বাসিন্দা।
আলম নামের আরেকজন বললেন, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে তাদের সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। তখন তিনি কুয়েতে ছিলেন। দেশে ফিরতে পারেননি। পরে ফিরে এসে দেখেন, ঘরবাড়ি কিছুই নেই। শেষ পর্যন্ত চট্রগ্রামের পতেঙ্গা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছেন ঢাকার এই বস্তিতে।
সরু অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরও অনেকের সঙ্গে কথা হল। তারা বললেন, এখানে থাকা মানে একরকম অনিশ্চয়তা। প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ আতঙ্ক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর আগুনের ভয় নিয়ে দিন কাটে। প্রায় প্রতি বছরই আগুন লাগে, পুড়ে যায় ঘরবাড়ি।
এই কঠিন বাস্তবতায়ও পরিবারগুলো টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কিছু উন্নয়ন প্রকল্প থাকলেও তা যথেষ্ট নয় বলে জানালেন তারা।
নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়েও বড় উদ্বেগ রয়েছে। আসমা নামের এক নারী জানান, বস্তির বাইরে কাজে গেলে তাদের সন্তানরা অনিরাপদ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা।
এই বিষয়ে আরেকটু ধারণা পেতে কথা বলি ফারজানা ফারুক ঝুমু নামের এক জলবায়ু কর্মীর সঙ্গে। তিনি জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের একজন ইয়ুথ অ্যাডভোকেট।
ঝুমু বলছিলেন, 'জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ না করায় এই মানুষরা শরণার্থী হিসেবে কোনো সাহায্য পায় না। অথচ তাদের নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।'
সবশেষে আমি বুঝেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রকৃতিতেই নয়, মানুষের জীবনেও গভীরভাবে পড়ছে। তাই এখনই প্রয়োজন কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া, যেন কেউ আর নিজের ঘর ছেড়ে এমন বাস্তুচ্যুত জীবনের শিকার না হয়।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৭। জেলা: ঢাকা।