ঋতুস্রাবের সময়টাতে অনেকে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে।
Published : 25 Oct 2023, 05:20 PM
মেয়েদের ঋতুস্রাব বা মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অথচ আমাদের জেলা বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীদের কাছে ঋতুস্রাবের বিষয়টি এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।
ঋতুস্রাবের সময়টাতে অনেকে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে।
ষষ্ঠ শ্রেণির শারিরীক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইয়ে ঋতুস্রাবের বিষয়ে একটি অধ্যায় আছে। সে অধ্যায়ে ঋতুস্রাব কত বছর বয়সে হতে পারে, ঋতুস্রাব হলে কী কী সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, এসব সম্পর্কে সেখানে বলা আছে। বইয়ে বলা আছে, নয় থেকে ১২ বছর বয়সে মেয়েদের ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হয়।
আমার প্রথম ঋতুস্রাব শুরুর আগেই এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম আমার মায়ের কাছ থেকে। এছাড়া বইয়েও পড়েছিলাম। আমার কাছে ঋতুস্রাব শুরু দিনটি আতঙ্কের হয়নি। তবে আমার বান্ধবীদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ঋতুস্রাবের প্রথম দিনটিতে ভয় পেয়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা ভয় আর লজ্জাবোধে পরিবারের কারো কাছেই সহজে প্রকাশ করতে পারেনি। সে সময়টাতে তারা নিজেদের বড্ড নিঃসঙ্গ মনে করেছিল। তারা যেন শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে মানসিক যন্ত্রণায় বেশি ভুগেছিল।
আমি যেমন ঋতুস্রাব নিয়ে আতঙ্কিত হইনি, তেমনি আমার ছোট বোনও ভয় পায়নি। ছোট বোনকে আমি আগে থেকেই এই সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রেখেছিলাম এবং ওর ঋতুস্রাবের শুরুর দিন থেকে তাকে মানসিক ভাবে সাহস যুগিয়েছি। আমাদের মাও আমাদের পাশে ছিলেন।
আমাদের দেশের অনেক বিদ্যালয়ে এখনো কিশোর কিশোরীদের বয়ঃসন্ধি কাল সম্পর্কে পড়ানো হয় না। তাই ঋতুস্রাব সম্পর্কে স্বাস্থ্যের যত্ন বিষয়ে অজনা থাকে অনেক কিশোরীর। ঋতুস্রাবের সময়ে কিশোরীদের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন হয়। অনেক পরিবারই এই বিষয়টি সম্পর্কে জানে না।
সমাজসেবামূলক আমার একটি সংগঠন আছে ‘প্রজাপতি স্কোয়াড’ নামে। এই সংগঠনের ব্যানারে আমি বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের সামনে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, বয়ঃসন্ধি, বাল্যবিয়ে সহ নানা বিষয়ে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। এসময় কথাও হয় আমার স্কুল পড়ুয়াদের সাথে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া অনেক ছাত্রীর সঙ্গে ঋতুস্রাব নিয়ে আমার কথা হয়। তাদের অনেকের অভিজ্ঞতা আমি শুনেছি সরাসরি। ওদের অনেকেই ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সঠিক নিয়ম জানতো না। স্যানিটারি ন্যপকিনের মূল্য বেশি হওয়ায় তারা এখনো ঋতুস্রাবের সময় কাপড় ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া, ঋতুস্রাবের সময়টাতে স্কুলে না আসার প্রবণতাও রয়েছে অনেকের মাঝে। এসময়টাতে বাড়ির বাইরে যেতে হয়না এমন কুসংস্কারও আছে ওদের অনেকের মাঝে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইজলাইন সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী, ‘‘মাসিক চলাকালীন ৪০ শতাংশ স্কুলছাত্রী গড়ে মাসে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। মাত্র ছয় শতাংশ স্কুলে মাসিক সম্পর্কে পড়ানো হয়। ৩১ শতাংশ স্কুলছাত্রী মনে করে, মাসিকের কারণে স্কুলে তাদের স্বাভাবিক লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে। ৮৬ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। মাত্র ১২ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় পরিষ্কার পানি ও সাবান দিয়ে ধোয় এবং শুকিয়ে নেয়।প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় ৮৬ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় স্কুলে তাদের ব্যবহৃত কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড বদলাতে পারে না।”
যদিও সময়ের সাথে এখন এই জরিপে পাওয়া চিত্রটা বদলেছে। অনেক স্কুলেই এখন ঋতুস্রাব নিয়ে নারী শিক্ষকরা ক্লাসে আলোচনা থেকে এসব নিয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আমার মনে হয় এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন ঋতুস্রাব নিয়ে নানা সচেতনতা কর্মসূচি। এছাড়া প্রতিটি বিদ্যালয় থেকেও ধারণা দেওয়া দরকার এ সম্পর্কে। এবং ঋতুস্রাব নিয়ে ট্যাবু ভাঙা শুরু করতে হবে প্রতিটি পরিবার থেকে।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৭। জেলা: বাগেরহাট।