দুর্গাপূজা যেভাবে জৌলুস পেল

দুর্গাপূজার সূচনা নিয়ে আছে নানা মতবাদ। তবে এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে রাজশাহীতে প্রথম দুর্গাপূজা পালন শুরু হয় বলে বেশির ভাগ মতবাদ থেকে জানা যায়।
দুর্গাপূজা যেভাবে জৌলুস পেল

হয়ত প্রাচীনকালে যে দুর্গাপূজা হতো তার প্রকৃতি ও রূপ ছিল ভিন্ন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লাইফ স্টাইল বিভাগে  এ নিয়ে লিখেছেন ইতিহাস গবেষক রিদওয়ান আক্রাম।

তার মতে, বাংলায় দুর্গাপূজা কবে চালু হয়েছিল সে বিষয়ে গবেষক ও পণ্ডিতব্যক্তিরা মোটামুটিভাবে একটি মতে পৌঁছেছেন।

ষোড়শ শতকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার দেওয়ান হন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ। এত বড় এক পদ পাওয়ার আনন্দে তিনি চাইলেন সেই পৌরণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করতে। তাই তিনি যান বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের শ্রেষ্ঠ পুরহিত রমেশ শাস্ত্রির কাছে।

তিনি বিষয়টি খুলে বললে শাস্ত্রী জানান বিশ্বজিৎ, রাজসূর্য, অশ্বমেধ ও গোমেধ-এই চার রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে। কিন্তু রাজার জন্য এই চারটির কোনোটাই করা সম্ভব নয়। আর এ নিয়ে রাজা পড়ে গেলেন দুচিন্তায়।

রমেশ শাস্ত্রী রাজাকে যজ্ঞের পরিবর্তে দুর্গাপূজা করার আহ্বান করেন। রাজা এটি শুনে তৃপ্ত হন এবং উৎফুল্ল  মনে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। জনশ্রুতি আছে ওই সময়ে দুর্গাপূজার আয়োজনে খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লক্ষ টাকা। আর তখন থেকেই বাংলায় শুরু হয় দুর্গাপূজা।

দুর্গাপূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য ঊনিশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তৎকালীন ভারত শাসন করা ইংরেজদের রাজধানী কলকাতা ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। তাদের শাসনযন্ত্রের অন্যতম সহকারী ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আর তাই তাদের কাছে টাকাকড়িও ছিল বেশ। ফলে দুর্গাপূজায় অন্যান্য উৎসবের মতো জৌলুসও যুক্ত হয়। সঙ্গে নিজস্ব মান-মর্যাদা আভিজাত্য প্রর্দশনের একটা বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়ায় এই পূজা। 

এই আনন্দোৎসবে তারা বেশ ঘটা করেই আমন্ত্রণ জানাতেন শাসকগোষ্ঠী ইংরেজদের। ফলে উৎসবের ব্যাপকতা আর জাকঁজমকতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

দুর্গাপূজা করার ক্ষেত্রে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুদের সঙ্গে যোগ হন জমিদাররাও। সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে দুর্গাপূজার উৎসবের ব্যাপকতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পাশাপাশি এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে এ বাংলায়।

বাংলাদেশের যে সমস্ত ভূ-স্বামী জমিদাররা বাস করতেন কলকাতায়, তারাও চাইলেন নিজ নিজ জমিদারি এলাকাতে এ ধরনের উৎসব চালু করতে। এখানেও বলা চলে, ধর্মীয় অনুভুতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর বিষয়টি। সেসব জমিদারের সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় ম্যধবিত্ত এবং ধনী ব্যক্তিবর্গ। ফলে তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় উৎসব হিসেবে পূর্ববঙ্গে দুর্গাপূজা এক ধরনের প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।

দুর্গোৎসবের আনন্দের মাত্রার রেশ ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র। এমনকি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যেত।

১৯০২ সালে ঢাকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ থেকে জানা যায়, ‘শারদীয় পূজা উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ হইতে চার সপ্তাহের নিমিত্ত ঢাকা প্রকাশ বন্ধ থাকিবে। গ্রাহক, অনুগ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষকবর্গের যথাযোগ্য অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমরা অবকাশ গ্রহণ করিতেছি। মা সর্ব্বমঙ্গলী সকলের মঙ্গল বিধান করুন।’

১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ধনী হিন্দু পরিবারগুলো এদেশ ত্যাগ করেন। এরপর থেকে এখানে একক ও পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশেষভাবে বললে, জমিদারি প্রথা উঠে গেলে বন্ধ হয়ে যায় দুর্গাপূজায় জমিদারদের একক পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে চাঁদা তুলে বারোয়ারি পূজা আয়োজনের সূচনা হয়। এটি চালু হওয়ার পর ব্যক্তি উদ্যোগে পূজার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং দুর্গাপূজা একটি গণউৎসবে পরিণত হয়। পুরোটাই গণ উদ্যোগে চাঁদা তুলে করা হয়। বর্তমানে ‘বারোয়ারি’ শব্দটির পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই ‘সর্বজনীন’ বা ‘সার্বজনীন’ শব্দদুটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com