দেশের প্রগতিশীল লেখক, কলামিস্টরা পাশবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে পত্রিকার পাতায় নিয়মিতই লেখেন আর প্রতিটি ঘটনার পর আমরা কিছু অভাগা রাজপথে নেমে আসি। আমার বোনের নির্যাতনের বিচার চাইতে। মিছিল, স্লোগান আর ব্যানার ফেস্টুনে ভরিয়ে তুলি রাজপথ। গণমাধ্যমে গরম গরম খবর আসে। তখন একটু নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। আমরা বিচার পাবার আশে ঘরে ফিরে আসি।
তারপর কোনো অগ্রগতিই দেখি না, আবার কোনো না কোনো বোনের নির্যাতনের বিচার চাইতে ফের নামতে হয় রাস্তায়। বাংলা প্রবাদ বাক্যে বলতে হয় ‘যাহা লাউ তাহাই কদু’।
আন্দোলন এখন বিচারের মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেবল এদেশে আন্দোলন করলেই বিচার পাওয়া যায়। আর আন্দোলন না করলে হয়তো থানায় মামলাও নেয় না।
২০১৯ সালে 'শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালে সারাদেশে চার হাজার পাঁচশ ৬৬টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার তিনশ ৫৪টি শিশু অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে এবং আটশ ১২ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন বলছে ২০১৮ সালে দুইশ ২৭ শিশু নিহত আর তিনশ ৫৬ শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার চারশ ১৩জন। পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় ৭৬ জনকে। আর পাশবিক নির্যাতনের চেষ্টা করা হয় দুইশ ২৪ জনকে। সে হিসাবে আরো দেখা যায় পাশবিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করেছে ১০ জন।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম গত বছরের শুরুতে এক হিসাবে বলেছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মোট চারশ ৯৬ জন শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়।
এই যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে আমরা তো অন্ধকার যুগে যুগে বসবাস করছি।
এবার বছরের শুরুতেই ঘুরে ফিরে আলোচনায় সেই যৌন নির্যাতন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বাস থেকে নামার পর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। সমাজের উঁচু মহল থেকে নিচু মহল সবাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বলেই হয়তো এত বিক্ষোভ এত প্রতিবাদ। আসামিও ধরা পড়েছে দ্রুত, এখন সঠিক বিচারের আশা সহপাঠী, শিক্ষার্থী আর দেশবাসীর।
আচ্ছা একবার ভাবুন তো যে মেয়েটি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে না, তাকে নিয়ে এত আলোচনা বা আন্দোলন হয় না আর তাই বিচারও পায় না। মা, বাবা কিংবা অভিভাবকহীন রাস্তায় যার বসবাস তার কী অবস্থা?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের এক পরিসখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার পথশিশু রয়েছে।
যাদের ৫৫ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় থাকে। যারা ফুল ব্রিক্রি করে আর ফুটপাতে ঘুমায়। সেই মেয়েটি হয়তো কোনদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাতেও পারে না। অথবা প্রতিনিয়ত কারো দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মুখ ফোটে কাউকে বলার সাহসটুকুও পাচ্ছে না। আর কাকেই বা বলবে রাস্তার এই মেয়েদের তো কেউ ভালোই মনে করে না। সবাই ‘খারাপ’ মেয়েই ভাবে। আর তাই নির্যাতন নীরবেই সয়ে যাচ্ছে এমন অনেকেই পাওয়া যাবে।
রাস্তার মেয়ের পাশবিক নির্যাতনের বিচার চাইতে মনে হয় না এ সমাজের কেউ রাস্তায় নেমে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিবে। কিংবা কেউ অনশন করবে।তাই এদের নির্যাতনের বিচার হয় না।
এদেশ নিয়ে আর কত লিখব। পরিবারই যখন মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা দিতে পারে না সেখানে রাস্তার মেয়ে নিয়ে কে ভাবে?
পঞ্চগড়ে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী (১৩) পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে, কামরাঙ্গীচরে কিশোরীকে (১৩) দলবেঁধে পাশবিক নির্যাতন, ভাটারায় ১১ বছরের শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এগুলো?
চলমান ঘটনা গুলো আমাকে বার বার পীড়া দিচ্ছে। খবরের পাতায় যখনই পাশবিক নির্যাতনের খবর দেখি। তখন খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়, আর বলতে ইচ্ছে করে প্রিয় দেশ তোমার বুকে আমার বোন নিরাপদ হবে কবে?