মহাকাশে বাংলাদেশ

মহাকাশ বিজয় অভিযানের একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে খ্যাত, ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। সেদিন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ মহাকাশে পাঠায়।
মহাকাশে বাংলাদেশ

এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি পৃথিবী থেকে পাঠানো প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ। বিশ্বের মানুষ চমকে যায় বিজ্ঞানের এ দু:সাহসিক পদক্ষেপে। শুরু হয় মহাকাশ যাত্রা।

এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একের পর এক তাদের কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ আরও অনেক দেশ কয়েক হাজার স্যাটেলাইট পাঠিয়ে মহাকাশ জয় করতে থাকে।

এদের কোনোটি মনুষ্য বহনকারী, কোনোটি চন্দ্র বিজয় করে আবার কোনোটি আন্তর্জাতিক যোগসূত্র স্থাপন করে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এদের দেখে বাংলাদেশও স্বপ্ন দেখে মহাকাশে তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানোর।

২০১৬ সালে জানতে পারি যে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে প্রেরিত হবে। খবরটি শুনে বেশ খুশি হয়েছিলাম যে, আমাদের দেশেরও একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকবে।

অপেক্ষা তখন থেকেই শুরু। ইন্টারনেট থেকে জানতে পারি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর মাঝখানে একটি লম্বা সময় বিভিন্ন ধারাবাহিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে ২০১৪ সালে বিটিআরসি, রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ কেনার আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন করে। ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস বঙ্গবন্ধু-১’র অবকাঠামো তৈরি করে।

তবে দেশের নিজস্ব উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ স্যাটেলাইটটিকে উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। সেখানে কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে ফ্যালকন-৯, ব্লক পাঁচে চেপে বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশের দিকে  যাত্রা শুরু করবে। উৎক্ষেপনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স।

এরপর কয়েকদফা তারিখ পরিবর্তন করলেও বিভিন্ন কারণে উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি।

শেষে বৃহস্পতিবার, বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারণ করা হয়।

বিটিভিসহ দেশের প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল, জেলা ও উপজেলায় এবং স্পেস এক্সের ইউটিউব চ্যানেলে উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকেন সরাসরি সম্প্রচার দেখতে ও ইতিহাসের সাক্ষী হতে।

কিন্তু হঠাৎ ৩টা ৩৭মিনিটে এসে থেমে যায় কাউন্ট ডাউন। তখন স্পেসএক্স জানায়, কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে উৎক্ষেপন স্থগিত করা হয়েছে। তবে চিন্তার কারণ নেই। রকেট ও স্যাটেলাইট দুইই ভালো অবস্থানে রয়েছে। উৎক্ষেপণের সময় আরও একদিন পেছানো হয়।

প্রধানমন্ত্রীরর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এস.ওয়াজেদ জয় সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকে একটি পোস্টে জানান, উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করা খুবই সাধারণ বিষয়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোনো ধরনের ত্রুটি দেখা দিলেই কম্পিউটারগুলো উৎক্ষেপণ বন্ধ করে দেয়। রকেট ও বঙ্গবন্ধু-১ উভয়ই  স্বাভাবিক, ত্রুটিমুক্ত এবং সক্রিয় আছে। তাই স্পেসএক্স আজ আবারও একই সময়ে উৎক্ষেপনের চেষ্টা চালাবে।

অবশেষে দেশবাসীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১২মে স্পেসএক্সের কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে ফ্যালকন-৯ এ চেপে নির্ধারিত সময়ে মহাকাশের পথে উড়াল দেয় বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১।

মহাকাশযুগের সূচনা ঘটে বাংলাদেশে। উল্লাসে জেগে ওঠে সমগ্র দেশ। ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্যাটেলাইটটি অবস্থান করবে। স্যাটেলাইটটি সক্রিয় হলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশের গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন থেকে এবং বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।

সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে তৈরি স্যাটেলাইটটির ৪০ টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি নিজ দেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে এবং বাকি ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বিভিন্ন দেশের কাছে ভাড়া দেওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের যে সব স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, ভিস্যাট ইত্যাদি বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করে কাজ করে তারা দেশীয় স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অর্থের সাশ্রয় করতে পারবে।

সেইসঙ্গ ২০টি ট্রান্সপন্ডার, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশকে ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অনলাইন সেবা পৌঁছে দেয়া, ইন্টারনেট ব্যবস্থার কার্যকারিতা, প্রাকৃতিক বিপর্যের পূর্বাভাস, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু-১।

২০২১ সালের মধ্যে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' তৈরির যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে আরও একটি ধাপ এগিয়ে গেলো বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো। বাংলাদেশ পেলো মহাকাশ নিয়ে গবেষণার সুযোগ, উন্মোচিত হলো উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণের মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট মালিকানাধীন দেশগুলোর তালিকায় নাম লেখালো বাংলাদেশ। সর্বোপরি বাংলাদেশ ইতিহাসের এক নতুন পাতায় পদার্পণ করল।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com