এটি একটি অনলাইন গেইম। প্রথমে সাদা কাগজে তিমি মাছের ছবি এঁকে শুরু হয় খেলা৷ তারপর খেলোয়াড়কে নিজেরই হাতে পিন বা ধারালো কিছু ফুটিয়ে নিজের রক্ত দিয়ে সেই তিমির ছবি আকঁতে হয়৷ চ্যালেঞ্জের মধ্যে একা ভূতের ছবি দেখতে হয়, আবার ভোর চারটা বিশ মিনিটে ঘুম থেকে উঠতে হয়৷ অতিরিক্ত মাদকসেবনও রয়েছে এরমধ্যে৷ গেইমের লেভেল যত এগোয়, ততই ভয়ংকর সব টাস্ক আসতে থাকে৷
অন্য নির্দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাদের একেবারে কিনারে গিয়ে ছবি তুলে পাঠানোসহ আরও ভয়ংকর কিছু। নিশ্চিত হতে টাস্কগুলিতে অংশগ্রহণের পর সেই ছবি গেইমিং পেজে পোস্ট করতে বলা হয়৷ গেইমের অংশ হিসেবে ব্যবহারকারীকে একসময় পাঠানো হয় তার মৃত্যুর তারিখ। ৫০তম টাস্কের শর্ত হিসেবে আত্মহননের নির্দেশ দেওয়া হয়।
একবার এ খেলায় অংশগ্রহণ করলে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। মাঝপথে খেলা বাদ দিতে চাইলে খেলোয়াড়কে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষতি করার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। খেলোয়াড়ের ফোন নম্বর ও ইমেল ঠিকানা শেয়ার করার ফলে ডেভেলপাররা বিভিন্ন ধরণের মানসিক আক্রমণ করে। মোবাইলে বার বার নোটিফিকেশন আসতে থাকে যা ওই মোবাইল ব্যবহারকারীকে গেমটি খেলতে বাধ্য করে৷
‘ব্লু হোয়েল’ গেমিং অ্যাপটি ডাউনলোড করা হলে কোনোভাবেই ডিলিট করা যায় না।
প্রচলিত ধারণা মতে, নীল তিমিরা মারা যাওয়ার আগে জল ছেড়ে ডাঙায় ওঠে, যেন আত্মহত্যার জন্যই৷ সেই থেকেই এই গেইমের নাম হয়েছে ‘ব্লু হোয়েল' বা নীল তিমি৷
২০১৩ সালে মরণ এই গেইমটি রাশিয়ায় ‘এফ৫৭’ নামে যাত্রা শুরু করে৷ ‘ব্লু হোয়েল' গেইম খেলার কারণে প্রথম আত্মহত্যার অভিযোগ আসে ২০১৫ সালে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ফিলিপ বুদেইকিন নামের এক সাবেক মনোবিদ্যা শিক্ষার্থী এই গেইম বানিয়েছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু কেন এই গেইম বানালেন তিনি?
তার দাবি, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে যাদের কোনো মূল্য নেই বলে তিনি বিবেচনা করেন তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করার মাধ্যমে সমাজকে পরিষ্কার করা।
বুদেইকিনকে পরে রাশিয়ায় আটক করা হয়। আর তার গেইমের জন্য অন্তত ১৬ জন কিশোরী আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়।
সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে বারুদের মতো গেইমটি ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বন্ধু-বান্ধবকে লিংক পাঠিয়ে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উৎসাহ দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও ব্লু হোয়েলের বিস্তার লক্ষ্য করা গেছে।
সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, পুনে ও ইন্দোরের দুই কিশোরকে আত্মহনন থেকে ফেরানো গেলেও পশ্চিম মেদিনীপুরের দশম শ্রেণির ছাত্র অঙ্কনকে বাঁচানো যায়নি। অঙ্কনের মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ৷
তাছাড়া মুম্বাইয়ের পূর্ব আন্ধেরির শের-এ-পঞ্জাব এলাকার বহুতলের ছয়তলা থেকে ঝাঁপ দেয় নবম শ্রেণির ছাত্র মনপ্রীত সিং। মৃত ওই কিশোরের মোবাইল আর কম্পিউটার ঘেঁটে ব্লু হোয়েলের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ৷ সম্প্রতি গোটা বিশ্বে, অন্তত একশ ৩০ জনের আত্মঘাতী হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ওয়েবসাইটের একসেস বন্ধ করে দিচ্ছে। লন্ডনের স্কুল কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে তাদের অভিভাবকদের সতর্ক করেছে। অবিলম্বে ব্লু হোয়েল বা এ ধরনের বিপজ্জনক গেমসের লিঙ্ক সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকারও।
এদিকে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যেহেতু হ্যাকাররা এই সুইসাইড চ্যালেঞ্জ পরিচালনা করে, তাই এটা ট্র্যাক এবং হান্টিং করা খুব কঠিন কাজ।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ নঈমা আক্তার বলছেন, ‘কিশোর-কিশোরীরা কৌতুহলপ্রবণ এবং ঝুঁকিপ্রিয়। তাই অভিভাবককে এ ধরণের ভায়োলেন্সের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ব্যতিক্রমী কিছু লক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কিশোর-কিশোরীদের নিজে সচেতন হওয়াকে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর জন্য কৌতূহল নয় বরং পৃথিবীটা যে কত বড় সেটা দেখার কৌতূহল থাকতে হবে।’