এ বিষয়ে কয়েকজন স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ার সঙ্গে কথা হয় হ্যালোর।
দশম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়। ওর মতে, ধূমপান হচ্ছে আধুনিকতা।
ও বলে, “আমি শুনেছি ইলেক্ট্রিক সিগারেট বের হয়েছে। ওগুলো নাকি তেমন কোনো ক্ষতি করে না। সো দিস ইজ মডার্ন ওয়ার্ল্ড। দ্যাটস হোয়াই আই ডোন্ট কেয়ার দিস ম্যাটার।”
তবে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাকদীর তানহা জয় ভাবছে অন্যভাবে। ওর মতে, ধূমপান করা আর আত্মহনন করা একই জিনিস।
নীরব ঘাতক জেনেও ধূমপানকে অনেকেই ‘ফ্যাশন’ হিসেবে নেয় জানিয়ে ও বলে, ‘স্মোকিং না করলে পুরুষ হওয়া যায় না, প্রেমিক হওয়া যায় না, আধুনিক হওয়া যায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে থাকে বন্ধুরা।’
জয় আরও বলে, ‘বন্ধুদের হাত ধরেই সিগারেটে হাতেখড়ি হচ্ছে অনেকের। তাই আত্মনিয়ন্ত্রণটা জরুরি।’
দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া আরেকজনের স্বীকারোক্তিতে শুধুই অসহায়ত্ব। ও বলে, ‘স্কুল লাইফে ধরে ফেলছিলাম। এখন আর ছাড়তে পারছি না। পেইনফুল।’
সরেজমিনে রাজধানীর ন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, আইডিয়াল কমার্স কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজসহ বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের কয়েক গজের মধ্যেই সিগারেট ব্যবসায়ীদের রমরমা ব্যবসা। যেখানে দুই থেকে ১০ টাকায় মিলছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের একটি সিগারেট। শিক্ষার্থীদের কাছেও তারা বিক্রি করছেন অবাধে।
এই বিষয়টিকে বড় করে দেখছে এইচএসসি পরীক্ষার্থী নজিবুর রহমান ছোটন।
তার মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে সিগারেটের দোকান রাখা যাবে না। ধূমপানে জড়াতে হলে যেন একজন শিক্ষার্থীকে বেগ পেতে হয়। তবেই এর সংখ্যা কিছুটা কমবে।
ছোটন জানায়, সে ফার্মগেটের একটি প্রতিষ্ঠানে পড়েছে। এই এলাকা সম্পর্কে তার বেশ ভালো ধারণা রয়েছে।
ও বলে, “হলফ করে বলতে পারি এখানকার এমন কোনো স্কুল, কলেজ কিংবা কোচিং সেন্টার নেই যেখানে স্টুডেন্ট ধূমপায়ীদের আড্ডা নেই।”
২০১৩ সালে বেসরকারি সংগঠন ‘ক্যাম্পেইন ফর ক্লিন এয়ার’ একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এক বছরে কিশোর ও তরুণ ধূমপায়ী বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর ৫৬ শতাংশ ১৮ বছরের আগেই ধূমপান শুরু করে।
এ বিষয়ে কথা হয় মনোবিদ রাওফুন নাহারের সঙ্গে। সিগারেটের সহজলভ্যতা এবং বন্ধুদের প্ররোচণাকে ধুমপানের জন্য দায়ী মনে করেন তিনি।
শিশুদের ধূমপানে আকর্ষিত হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সিনেমা, নাটক কিংবা চারপাশের পরিবেশ থেকে তাদের কাছে এক ধরনের বার্তা পৌঁছায় যে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় কিংবা টেনশন, হতাশায় সিগারেট খেতে হয়।’
ধুমপান বন্ধের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকা মূখ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পারিবারিক শিক্ষাই শিশুকে এসব ক্ষতিকর পথ থেকে দূরে রাখতে পারে। সেজন্যে অভিভাবকদের সন্তান লালন-পালন বা প্যারেন্টিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার। যা বিভিন্ন মনোসামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে থাকে।’
চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট' সম্প্রতি কয়েক শ’ বিজ্ঞানীর তথ্য দিয়ে ‘গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজেস' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধূমপায়ী বসবাসকারী দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে৷ এছাড়া গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা হারের দিক থেকে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) তথ্য অনুসারে প্রতিবছর তামাকজাতীয় দ্রব্যের কারণে বাংলাদেশে ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। পঙ্গু হয় আরো তিন লাখ ৮২ হাজার মানুষ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলেও জানায় ডব্লিওএইচও।
কথা হয় ঢাকা কমার্স কলেজের শরীর চর্চার শিক্ষক ফয়েজ আহমেদের সঙ্গেও। শিক্ষার্থীদের ধূমপান ঠেকাতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে অবিরাম চেষ্টা থাকে আমাদের। তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরে বের হয়ে গেলে তখন তো আর আমাদের কিছু করার থাকে না।’
এ বিষয়ে সরকারের গৃহীত আইন সম্পর্কে আইনজীবী নজরুল ইসলাম হ্যালোকে জানান, তামাক নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০১৫ অনুযায়ী ১৮ বছরের কমবয়সী কারো কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে কোনও ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন।