আমার কথা

গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’: এক মহাকাব্যের নকশী কাঁথা

গার্গী তনুশ্রী পাল

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক স্মৃতিকথা লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তার সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনী পরে প্রকাশিত হয়। এরই অবলম্বনে চিত্রিত হয়েছে গ্রাফিক নভেল মুজিব।

এই গ্রাফিক নভেলে আছে তার আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, জন্ম ও শৈশব, স্কুল ও শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা।

১৯৬৭ সাল। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি এক নির্ভীক মানুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হঠাৎ একদিন কারাগারের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা।

গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’-এর শুরুটা এভাবেই। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লিখা এই কমিকস সিরিজটি প্রকাশ করেছে সিআরআই প্রকাশনী। দশ পর্বের বইগুলোর প্রচ্ছদে লাল রঙে লেখা ‘মুজিব’ নামটি যেন আমাদের পতাকার লাল সূর্য।

১৯৩৮ সাল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চোখে মুজিব ধরা পড়লেন অনেকের মধ্যে একজন হয়ে। ‘আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র’ ইসলামিয়া কলেজে পড়তে পড়তেই রাজনীতি শুরু করলেন ভীষণভাবে। হয়ে উঠলেন ছাত্রদের প্রাণপ্রিয় নেতা।

দশ পর্বের এই গ্রাফিক নভেল যেন এক জীবন্ত চলচ্চিত্র। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে উঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির শৈশব। চোখ অপারেশনে ভয় পাওয়া ছেলেটিই মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে বারবার।

তার স্কুল, ফুটবল প্রীতি, কিশোরসুলভ অভিমান, কলেজ জীবন, সামাজিক দায়, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রায়িক দাঙ্গা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ষড়যন্ত্র থেকে বের করে আনা, ভাষা আন্দোলন, ছাত্র জীবন শেষ হতেই ছাত্রলীগ থেকে সরে যাওয়া, কারাবাস এমন সবকিছুই এসেছে দারুণ ভাবে। এসেছে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানীসহ শত্রু-মিত্র অনেক নেতার-কর্মীর কথা।

দশম সংখ্যা ‘মুক্তির পথে’ বঙ্গবন্ধুর পায়ে পায়ে চলা ভালোবাসা আর বিশ্বাসঘাতকতার এক অনবদ্য কাব্য।

বুকের ভিতর যার বিশ্বাসের নদী, দেশের জন্য যার অন্তহীন ভালবাসা, সৎপথ ছাড়া আর কিছুর চর্চা যিনি করেননি কোনোদিন, বিপদ তার পিছু ছাড়ে না।

এই আত্মজীবনীতে উজ্জ্বল নক্ষত্রেরমত এক গৃহবধূর নাম এসেছে, তিনি জাতির জনকের স্ত্রী, শেখ ফজিলাতুল্লেছা মুজিব, জাতির পিতা যাকে ডেকেছেন রেণু নামে। আন্দোলন, সংগ্রাম, রাজনীতি, জাতি গঠনে বঙ্গন্ধু যখন রাজপথে কিংবা জেলে, দেখা না হওয়া দিনের যখন কোনো হিসেব নেই, তখন সর্বংসহা হয়ে ঘর-সংসার সামলেছেন তিনি।

১৯৫০ সালের শেষের দিকে তিনি এক জাহাজে চড়ে গোপালগঞ্জে যাচ্ছিলেন মামলার হাজিরা দিতে। ভেবেছিলেন এবার হয়তো দেখা হবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সাথে। কিন্তু হায়! বঙ্গমাতা যে শিশু পুত্র, কন্যাকে নিয়ে গোপালগঞ্জ থেকে উঠেছেন অন্য জাহাজে তারই সাথে দেখা করতে। এ যেন মহাকাব্যের মধ্য অংশ। এ বইটি না পড়লে রোমান্স-বেদনার এমন দৃশ্যের দেখা হয়তো আর নাও হতে পারে।

স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান সরকারের মামলা-মামলা খেলা আঠারো মাস ধরে চলতে থাকে। জামিন পেয়েও আবার গ্রেপ্তার হন। জাতির পিতা সীদ্ধান্ত নেন ‘অন্যায় না করে আর জেলে থাকব না।’ তাই অনশন। জোর-জবরদস্তি চলতে থাকে অনশন ভাঙানোর। কিন্তু পাহাড়কে টলিয়ে দেয় এমন সাধ্য কার?

‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী রাখা, তাকে আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে।’ এমনভাবেই জেলজীবনের প্রতি তার অনুভবের কথা বলেছেন ইতিহাসের এই মহানায়ক।

সহজ শব্দ, ঘটনার ধারাবাহিকতা, মন জুড়ানো ছবি, সব মিলিয়ে এ যেন শেষ না হওয়া এক মহাকাব্যের গ্রন্থনা।

অজপাড়াগাঁয়ের দুরন্ত ছেলেটি কীভাবে হয়ে উঠলেন একটি জাতির জনক তা সহজে জানতে হলে, খুলতে হলে বন্ধ মনের জানালা, অবশ্যই পড়তে হবে মহাকাব্যের এই নকশী কাঁথা।

প্রতিবেদকের বয়স: ১৩। জেলা: ঢাকা।
SCROLL FOR NEXT