কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় এক তলা সমান লোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে গেল পুরো এলাকা।
Published : 25 May 2021, 11:28 PM
২০০৯ সালের ২৫ মে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর ঝড়ো হওয়া বইছিল। ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় আমাদের অঞ্চল।
আমাদের বাড়ি থেকে আধা-এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওয়াপদা বাঁধ ছাপিয়ে পানি আসা দেখে আম্মু আমাকে নিয়ে দ্রুত কাকুদের ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম প্রবল ঢেউয়ের সাথে ভেসে যাচ্ছে আমার নিত্যদিনের সঙ্গী খেলনাগুলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় এক তলা সমান লোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে গেল পুরো এলাকা।
এখানে থাকা আর নিরাপদ মনে হলো না। কাকু তখন আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি একটা নৌকার ব্যবস্থা করলে আমরা সবাই তাতে করে ওই মুহুর্তেই আমাদের স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাই। ওখানেই রাত হয়। সেই রাতের কথা আমার তেমন মনে নেই। আম্মুর কোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
সকাল হতেই আতঙ্ক শুরু হলো। দাদুকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চারিদিকে নোনা পানি ছাড়া আর কিছু নেই। বাড়ি ঘর, গাছ-পালা ভেঙে চুরমার। চারিদিক এক রাতের মধ্যেই চেনার মতো কিছুই থাকল না। আমাদের বাড়িতে কত রকমের ফুল আর ফলের গাছ ছিল তার একটাও অবশিষ্ট ছিল না সে রাতের পর।
দাদুকে না পেয়ে অনেকেই নৌকা নিয়ে খুঁজতে গেল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। সবার মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল। দাদু আমার অনেক প্রিয় মানুষ। উনি বাড়িতে ঢুকে প্রথম আমার খোঁজ করতেন। আমি যেহেতু বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছিলাম তাই দাদু আমাকে ছোট ভাই বলে ডাকতেন।
দুদিন খোঁজার পর আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে দাদুর লাশ পাওয়া গেল। তখন আর কেউ স্থির থাকতে পারল না। পরিবারের সবাই ভেঙে পড়ল। আমিও সেদিন অনেক কেঁদেছি।
ওইদিনই আমরা যশোরে ছোট কাকুর বাড়িতে যাই। যেতে যেতে পানিতে কত লাশ ভাসছিল তার হিসাব নেই। সন্ধ্যার দিকে কাকুদের ওখানে দাদুকে দাফন করা হয়।
আজ ১২ বছর পরও শত স্মৃতির মাঝে ওইদিনের স্মৃতিই জ্বলজ্বল করে। এই বিষয়ে কেউ গল্প করলেও আমি সেখান থেকে সরে পড়ি। শুনলে আমি আবেগে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
আমরা উপকূলের মানুষ আজও স্বাভাবিক হতে পারিনি। প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ফণী, বুলবুল, আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়কে মোকাবেলা করেই বেঁচে থাকতে হয়। ওয়াপদা বাঁধগুলো এখনও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। মে থেকে জুন মাস আসলেই আমাদের নির্ঘুম রাত কাটে। এখানকার বাসিন্দাদের একটাই দাবি, 'ত্রাণ নয়, বাঁধ চাই'।
আমার মতো প্রতিটি উপকূলীয় মানুষের এরকম হাজারও হারানোর গল্প রয়েছে যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।