জিপিএ-পাঁচ, চাকরি, নৈতিকতা ও কিছু কথা

আমার বয়স ১৮ ছুঁই ছুঁই। অথচ আমি শিক্ষা বলতে কী বোঝায় জানি না। অথচ গাদাখানিক পাবলিক পরীক্ষায় বসেছি, পাশ করেছি। কিন্তু শিক্ষা কী জিনিস তা মাথায় ঢোকেনি আজও।
জিপিএ-পাঁচ, চাকরি, নৈতিকতা ও কিছু কথা

এদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে আমি যদি জিপিএ-পাঁচ পাই তবেই শিক্ষিত। আচ্ছা, একটা জিপিএ-পাঁচ পাওয়া ছাত্র যদি একজন বাবার বয়সী রিকশাচালককে তুই বা তুমি বলে সম্বোধন করে আর আরেকজন একবার এসএসসিতে খারাপ করা ছাত্র যদি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করে তাহলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ছেলেটাকেই আমার শিক্ষিত বলে মনে হবে।

যদিও আমাদের নৈতিক শিক্ষা থেকে জিপিএ-পাঁচ এর দাম বেশি। আমি যদি এসএসসিতে জিপিএ-পাঁচ না পেতাম, তাহলে আমি কোনো ছাত্রই না। জেএসসিতে যখন আমি জিপিএ-৪.৮৫ পাই তখন শিক্ষক থেকে শুরু করে অনেকেরই কটু কথা মুখ বুজে সহ্য করেছি। যখন এসএসসিতে জিপিএ-পাঁচ পেলাম, সে কী আনন্দ সবার!

আমরা টাকার পেছনে দৌড়াই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য টাকা আয় করা। আমাকে পড়ালেখা করে ভালো একটা চাকরি করে টাকা কামাতে হবে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সবাই নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াতে ব্যস্ত। জিপিএ-পাঁচ থাকলে সহজেই চাকরি হয়। তাই এই সোনার হরিণ জিপিএ-পাঁচ যে কোনো মূল্যে পাওয়া আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

শুধু স্কুলের পড়ায় কাজ হয় না, একটা কোচিং দরকার, দুই/তিন জন প্রাইভেট টিউটর দরকার। মন না চাইলেও পড়তে হবে। খেলাধুলা বলে আমাদের অভিধানে কোনো শব্দ থাকবে না, থাকে না। সারাদিন পড়া আর পড়া। যারা দিনে যদি চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে ২০ ঘণ্টা বইয়ে মাথা গুঁজে থাকে তারা হচ্ছে ভদ্র ছাত্র।

আমি সব থেকে অবাক হই, যখন সবাই দল বেঁধে অমুক স্যারের বাসায় আর কোচিং সেন্টারে দৌড়ায়। টাকার বস্তা ঢালা হয় সবার পেছনে। যার টাকা যত বেশি তার ছেলে তত সুবিধা পায়। পড়ালেখাটা পুরো বাণিজ্যিক বানানোর কৃতিত্ব আমাদের অভিভাবকদের। ছেলেকে স্কুলে না পাঠিয়ে পাঠানো হয় কোচিংয়ে। যদি কেউ পড়তে না চাই, জোর করে পড়া গেলানো হয়। জোর করতে করতে আমরাও একসময় টাকার নেশায় পাগল হয়ে যাই।

স্নাতক পাশ করার পর প্রধান টার্গেট 'বিসিএস ক্যাডার হওয়া'। সারা ছাত্র জীবনে যত টাকা ঢালা হয় তা উপার্জন করার পথ খোঁজে সবাই। যখন কেউ বড় পদে চাকরি পায়, শুরু করে দুর্নীতি। সবাই হয়তো করেন না, কিন্তু বেশির ভাগই করেন।

আমার চোখে হাতেগোনা কয়েকজন সফল। তাদের বেশিরভাগ বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। সেখানে যখন সফলতা লাভ করে, তখন তার সাফল্য পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন আমরা গর্বিত হই। আমরা যে নিজেদের মেধাবীদের ধরে রাখতে পারি না তার জন্য কি আদৌ চিন্তা করা উচিত?

এবার আসি আমার এক ঘটনায়। গ্রামের এক স্কুলে পড়েছি। সাইন্সের একজন স্যার একাই সব বিষয় পড়াতেন। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানের এমন এক অঙ্ক আসলো যার সমাধান কোনোদিন চোখেও দেখিনি। অথচ সাধারণ সূত্র কাজে লাগিয়ে নিজের বুদ্ধি দিয়ে সমাধান করে নিজেকে একজন বিজ্ঞানী মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেদিন উৎসাহ দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি।

হয়তো কেউ উৎসাহ দিলে আরো অনেক কিছু নিয়ে পড়তাম। কিন্তু সমাজব্যবস্থার কাছে আশাহত। এখনো স্বপ্ন দেখি একদিন পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার। আমরা ও তো পারি নিজেদের মেধাবী ধরে রেখে মহাকাশে অনুসন্ধান চালাতে? সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা কবে দেখবো আমরা?
নাকি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবো?

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com