মা, ভালো থেকো!

তখন দাখিল পরীক্ষা। বাড়ি থেকে ফোন এলো- মায়ের প্রচণ্ড অসুখ। শুরু হয় ভেতরে অস্থিরতা।
মা, ভালো থেকো!

কোনো রকম পরীক্ষাটা শেষ করলাম। বাড়ি ফিরে দেখি, অবস্থা ভালো না। আবার যেতে হলো ডাক্তারের কাছে। হবিগঞ্জের নাম করা ডাক্তারকে দেখানো হয়েছে, উনি আসেন ঢাকা থেকে।

দ্বিতীয়বার যাওয়ায় অনেকটা ক্ষেপে গেলেন তিনি। বললেন, ‘এত অস্থির হচ্ছেন কেন? রিপোর্ট তো ভালো এসেছে। রোগীর কোনো মারাত্মক সমস্যা নেই। গ্যাস্টিকের প্রবলেমে এমনটা হয়েছে। বাড়ি যান।’

হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার অবস্থা আরও বেগতিক। মধ্যরাতে প্রায়ই কান্নার শব্দ আসে পাশের রুম থেকে। বাচ্চাদের মতো কান্না। মা কাঁদেন। আমার খুব খারাপ লাগতো। মনে হতো, আমার ভেতরটা কে যেন করাত দিয়ে কেটে চলেছে অবিরত। আমি সহ্য করতে পারতাম না সে কান্না। বালিশ চাপা দিয়ে নীরবে অশ্রু ফেলতাম শুধু। তারপর মাকে নিয়ে সিলেট গেলাম পনের দিন পর। এবার রিপোর্টে এলো, জন্ডিস, টিউমার, পাথর! দ্রুত নিয়ে গেলাম ঢাকায়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হলো। এক বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বললেন, ‘রোগ জটিল হয়ে গেছে। আমাদের ওখানে এর কোনো সমাধান নেই। আরেকটু আগে এলে হয়তো…!’

আমরা মাকে এরচেয়েও ভালো এক হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। টেস্ট করা হলো। সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়। ভাইয়া রিপোর্ট নিয়ে বাসায় ফিরলেন। বোনের বাসা।  আমরা মাকে ঘিরে গল্প করছিলাম তখন। ইশারায় আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন ভাইয়া। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি ভাইয়ার কথা শুনে। কে যেন গলা খামচে ধরে আছে আমার। মায়ের এত জটিল সমস্যা! আমার মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। তখনও কথাটা কেউ জানতো না আমরা দুজন ছাড়া।

ভাইয়া পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন, ঢাকা মেডিকেলে একটা কেবিন পাওয়া যায় কিনা। সে এক মহা কাণ্ড। ঘুষ ছাড়া নাকি কেবিন মেলে না। আহা আমাদের অসহায় দিন! সবখানে দালালে সয়লাব। বহু তদবির করে সাতদিন পরে একটা কেবিন পাওয়া গেল।  কিন্তু বিশেষ কোনো ফায়দা হলো না। ডাক্তারদের একই কথা, রোগীর কোনো চিকিৎসা নেই। এদিকে মায়ের অশান্তি বেড়েই চলেছে দিনদিন। সারা শরীর চুলকায় এবং ঢাকা শহরের যানজটে সেটা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে মা বলে উঠলেন, ‘আমাকে তোমরা বাড়ি নিয়ে চলো। আমি আর ঢাকায় থাকব না। মরলে বাড়ি গিয়ে মরব।’

আমরা হাল ছাড়লাম না তবুও। এখানে-ওখানে নিয়ে যেতে থাকি একটা মিথ্যে আশায়। কিন্তু সবখানে একই বাক্য- ‘কোনো চিকিৎসা নেই!’ পনের দিন পর বাড়ি ফিরলাম মাকে নিয়ে।

প্রায় দুই মাস পর। মায়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে নিয়ে গেলাম সিলেটের আরেক বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে। কে না চায়, পৃথিবীতে দুটো দিন বেশি বাঁচতে! আবারও নানান পরীক্ষা এবং ঝামেলা। ফায়দা হয়নি একটুও। এরইমধ্যে আমি খেয়াল করলাম- মায়ের শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। গায়ের ফরসা রঙটা আর নেই। ঘোলাটে নীলাভ হয়ে গেছে ত্বক। ঘুম হয় না। খাওয়া বন্ধ। পরিবারের সবাই অস্থির সময় পার করছি। দুশ্চিন্তার শেষ নেই। যেন একটা ছন্নছাড়া পরিবার। দাঁড়াতে পারছে না কোনোভাবেই।

কলেজে যাই, ক্লাসে মন বসে না। পড়তে বসি, ভাল্লাগে না। ঘুমোতে যাই, চোখে ঘুম আসে না। মায়ের ফ্যাকাসে অবয়বটা সবসময় যেন ভেসে ওঠে। আমাকে তাড়া করে। বাড়িতে ফোন করি কম। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না। ওপাশ থেকে জীর্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলেই গলায় শব্দ আটকে যায় আমার। ‘কেমন আছো মা টাইপ ছাড়া ভালো কোনো বাক্য বলতে পারি না। আর আমি জানি- মা ভালো নেই; তবু জিজ্ঞেস করি একই কথা বারবার। কোনোদিন কেবল বাবার থেকেই খবরটা নিয়ে নিতাম। সিলেটে একা থাকি, এমনিতেই কষ্টকর জীবন; তার উপর খাওয়াদাওয়া নেই ঠিকমতো। ভাত মুখে দেওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে মনে হতো আচ্ছা, মা কি খেয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে ঠাণ্ডা হয়ে যেত প্লেটের ভাত।

এসময় আমার হঠাৎ কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আফসোস করে বলে উঠতো, ‘তুই দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছিস তো!’ কৃত্রিম হাসি মুখে নিয়ে বলতাম- আমি তো সবসময়ই এমন। মোটা ছিলাম কবে!

দুঃসময়ে পাশে থাকে খুব কম মানুষ। আমার বেলায়ও তেমনি। সম্পর্ক কারও সঙ্গেই ভালো যায়নি তখন। কটা মানুষ পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছে, অভয় দিয়েছে কিংবা ভেঙে না পড়ার গল্প শুনিয়েছে; এমন হয়নি। স্বয়ং আমি নিজেকে মোটিভেট করতাম, ভেতর থেকে সাহস দিয়ে যেতাম। তবে দুয়েকজন ভিন্ন ধাঁচের মানুষ ছিল; যারা আমায় সাহস যুগিয়েছে। গল্প শুনিয়েছে। ভালোবাসার গল্প।

একদিন কলেজ বন্ধ হয়। বাড়ি যাই। রাস্তায় একটু দেরি হয় আমার। বাড়ি থেকে বারবার ফোন আসছে। সেদিন রাত নামে রাস্তার মধ্যে। বাধ্য হয়ে এক বন্ধুর বাড়ি উঠি। পরদিন ফিরলে মা খুব অভিমান করে বসেন। কথা বলবেন না আমার সঙ্গে। মুখ ফিরিয়ে নেন। আমি চুপচাপ উঠে পড়ি। জানি, এখন কথা বললে মা উল্টো রাগ করবে। খানিক পরে আবার গেলাম। মায়ের শিয়রে বসে মাথায় হাত রাখলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, মায়ের চোখে জল। কান্নার সুরে বলছেন, আমি গতকাল থেকে অস্থির হয়ে আছি তোকে দেখার জন্য। আর তুই কিনা… বুঝে গেলাম- আমার দেরিতে মায়ের অভিমান। আস্তে করে জড়িয়ে ধরলাম মাকে, অভিমান ভাঙানোর জন্য। চোখের পানি আটকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম তখন। মা বলতে থাকেন, ‘আমার মরতে ইচ্ছে করে না রে বাজান। আল্লাহয় যদি আমায় এই অবস্থায়ই সারা জীবন রাখে, তবু আমি খুশি। শুয়ে শুয়ে যেন শুধু তোদের দেখতে পাই, তোদের স্পর্শ পাই। আমি শুধু বাঁচতে চাই তোদের মুখের শব্দ শুনার জন্য।’

মায়ের আকুতি শুনে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম একদম। অনেক জোর করে, হিমালয় চূড়ায় উঠার মতো শক্তি ব্যয় করে, একটা মাত্র বাক্য আমি বলতে পারলাম- তুমি বাঁচবে মা! সেদিন স্পষ্ট দেখেছিলাম পৃথিবীতে একজন মানুষের বেঁচে থাকার কী আকুতি!

সাতদিন পরের ঘটনা...

নিশুতি রাতে মার কান্না আসে পাশের রুম থেকে। পাগলের মতো ছুটে গেলাম। মা বমি করতে চাচ্ছেন, হচ্ছে না। বহু চেষ্টা করেও কিছু বের করতে পারলেন না ভেতর থেকে। একসময় রক্ত বেরিয়ে এল। মার কষ্ট দেখে আমরা কান্না শুরু করে দিলাম। আধ ঘণ্টা পর অবস্থা স্বাভাবিক হয় কিছুটা। পাশে বসে হাত বোলাতে লাগলাম মায়ের মাথায়। আমার চিকন এবং নরম আঙুলের স্পর্শ নাকি উনার খুব আরাম লাগে। বাড়ি গেলে প্রায়ই এভাবে মাথায় বুলিয়ে দিতাম। মা খুব খুশি হতেন। সেদিন রাতে নিয়ত করলাম, সারা রাত চুলে বিলি কেটে দেব। একবার মায়ের ঘুম ভেঙে গেলে বলে উঠেন, ‘তুই কি এখনো ঘুমাসনি?’

পরদিন সকাল। শুক্রবার। নয়টার দিকে আবারও চিৎকার এলো। উঠে গিয়ে দেখি- মায়ের অবস্থা ভালো না। হাঁপাচ্ছেন। মাথায় পানি দেওয়া হয়। বমি করতে গেলে সেই আগের মতো অবস্থা। একটু পরে শান্ত হয়ে যান। শুয়ে থাকেন নীরবে। পানি খেলেন কয়েক ঢোক। কথাও বললেন একটু। পনের মিনিটের সময় মা আবার বমি করতে চেষ্টা করলে, আমার হাতের মুঠোয় রাখা তার হাতগুলো শক্ত হতে থাকে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। পালসের কম্পন থেমে যায়। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, আমি অনাথ হতে চলেছি... কানের কাছে মুখ নিয়ে কালেমা শাহাদাত পড়তে থাকি জোরে জোরে…

মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। সবাই কান্নাকাটি করছে, কিন্তু আমার আর্তনাদ যেন বুকের মধ্যে থেমে যায়। বেরোতে চায় না। গলায় কাঁটা বিঁধলে যেমন হয়, আমারও তেমনি। কান্নাগুলো যেন কাঁটা হয়ে বুকে বিঁধে আছে। বেরোচ্ছে না। চোখ দুটো হয়ে গেছে সাহারা মরুভূমি। আমি শেষ কখন কেঁদেছিলাম? ঠিক মনে নেই। এক ফোঁটা অশ্রুর জন্য কত ব্যর্থ চেষ্টা!

মার উজ্জ্বল চেহারা এখনো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী অলৌকিক আলোয় মাখা ছিলো সে মুখ। মৃত্যুর আগে তার কাছে কম যেতাম। মায়ের পাশে গেলেই অনুভব করতাম এক ধরনের অস্থিরতা। তার বদলে যাওয়া অবয়বটা দেখলেই সারা শরীর শীতল হয়ে উঠতো। অনেকে দেখা করতে এলে ক্ষমা চায়।

আমারও ইচ্ছে হলো-মার কাছে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কতবার যে কাছে যেয়েও ফিরে এসেছি, হিসেব নেই। কেন যেন মনে হতো- ক্ষমা চাওয়া মানে, পৃথিবী থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া! পরপারে সুখে থেকো মা!

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com