মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। আমার এই মাধ্যমিক পরীক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্লাস নাইন থেকে। তখন যেখানেই বেড়াতে যেতাম সেখানেই মানুষ বলত, ‘ও বাবা! এবার তো তোমার এসএসসি পরীক্ষা। ঠিক মতো লেখাপড়া করো।’ আমার যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগতো সেটা হলো আমার জন্য মা-বাবা কোথাও যেতে পারতেন না।
মাধ্যমিক পরীক্ষার কয়েক মাস আগে বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমার পুরো পরিবার আমার সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে! অর্থাৎ, ক্লাস নাইন-টেন, এই দুই বছর পরীক্ষা পরীক্ষা করে আমার জীবন হাঁসফাঁস করছিল। তাই পরীক্ষার পর জীবনের অস্থিরতা কাটিয়ে তুলতে চলে গেলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণে।
খালা, ফুপু ও আমাদের পরিবারসহ আমরা মোট ১৩জন রাজারবাগ বাস স্টেশন থেকে বাসে রওনা হলাম কক্সবাজার। তবে শুরুতেই আমাদের ভ্রমণে বাধা আসে। ঠিক যখনই বাসের চালক বাস স্টার্ট দিলেন, তখনই দেখা গেল যে বাস স্টার্ট হচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল যে, আমাদের বাসের চাকায় একটা পিন ঢুকেছে। তাই চাকাটি পরে খুলে ঠিক করে লাগানো হয়। চাকায় পিন ঢোকার ঘটনাটির ফলে আমাদের বাস ছাড়তে একটু দেরি হয়ে যায়। আমাদের বাস ছাড়ার কথা ছিল রাত দশটায় কিন্তু এই ঘটনার ফলে আমাদের বাস ছাড়ে এগারোটা চল্লিশ মিনিটে।
যেহেতু আমাদের যাত্রাটি রাতে ছিল, তাই বাস চলার কতক্ষণ পরেই বাসের সবগুলো লাইট বন্ধ হয়ে যায়। বাসে আমার সিটটা ছিল জানালার পাশে। বাসের সকলে ঘুমিয়ে গেলেও, আমি রাত জেগে দেখেছি লাল-নীল, হলুদ-সবুজ রঙের বাতিতে জড়ানো আমার শহর ঢাকাকে।
পরের দিন সকাল দশটায় আমরা কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছালাম। সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, বিশাল সমুদ্র, নীল জলরাশি ও শো শো গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার।
বাস থেকে নেমেই সমুদ্রের এই অপরুপ সৌন্দর্য দেখে ইচ্ছে করছিল এখনই সমুদ্রে ঝাপ দিই! আমরা কক্সবাজারের যেই কটেজে তার এক পাশে একটি সুইমিং পুল, আরেক পাশে গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা একটি ছোট্ট কটেজ এটি। আমাদের কটেজটি থেকে সমুদ্র খুব বেশি দূরে ছিল না। তাই যখনই ইচ্ছে করত আমরা সমুদ্রে চলে যেতাম।
সমুদ্রের দিকে তাকালেই আমার মনে হয় যেন সমুদ্র যেন জীবন্ত! মনে হয়, সমুদ্র কথা বলে। ঠিক একজন মানুষের মতো। মানুষ যখন রাগ হলে খুব আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, ঠিক সমুদ্রও তেমনই। আমার মনে হয় সমুদ্র যখন রেগে যায়, তখন সেটিকে বলা হয় জোয়ার। আবার যখন সমুদ্র শান্ত হয়ে যায়, তখন সেটিকে বলা হয় ভাটা।
বাস থেকে নেমে সমুদ্র দেখে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করেছিল। যা হয়তো শুধু আমার নয়, ইট কাঠের শহর ঢাকা ছেড়ে সকলেই যখন প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে এখানে আসেন সকলেরই হয়তো এই একই অনুভূতি হয়। এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি যা বলে বোঝানো যায় না।
এটা অনেকটা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত একটি কিশোরী যখন আকাশ দেখার সুযোগ পায় না, খেলাধুলার জন্য কোনো জায়গা পায় না, পড়াশোনা আর পরীক্ষার বেড়াজালে বন্দি, সে যদি একদিন বিশাল সমুদ্র সৈকতে এসে হাজির হয় কেমন লাগবে তার? ভালো লাগাটা ঠিক এরকমই।….(চলবে)