টাকার বিনিময়ে বন্ধকে শৈশব

আমাদের দেশে শিশুশ্রমের একটি বড়ক্ষেত্র হচ্ছে গৃহে শিশুশ্রম। আমরা খুব সহজ ভাষায় কথাটা বলি-‘গৃহকর্ম!’ কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কী আমরা যত সহজে এই কথাটা বলি, কাজটা কী ঠিক ততটাই সহজ?
টাকার বিনিময়ে বন্ধকে শৈশব

শিশুদের বাসাবাড়িতে কাজ করার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও সাধারণত বলা হয়, ‘শ্রমবাজারে শিশুদের সম্পৃক্ততার কারণই হলো দারিদ্র্য।’ যেহেতু বাড়ির কাজকর্মে শিশুরা সাহায্যে করে থাকে, তাই মা-বাবারও সন্তানকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানোর বিষয়টি শিশুর ‘স্বাভাবিক’ কাজের বাড়তি অংশ বলেই ধরে নেন।

শিশু গৃহকর্মীদের প্রধান কাজ হলো বাজার করা বা বাড়ির শিশুদের দেখাশোনা করা। এ ছাড়া ঝাড়পোছ, কাপড় ধোয়া তো আছেই। নিজে একজন শিশু হয়ে সে আরেকজন শিশুকে দেখাশোনা করছে জীবনের পরিস্থিতি কবলে পড়ে!

অন্য শিশুর স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, বোতলে পানি ভরে দেওয়া, টিফিন তৈরি করে দেওয়া ইত্যাদি সব কাজই তাকে প্রতিনিয়তই করতে হচ্ছে। অথচ এই বয়সে তার বই, খাতা, পেন্সিল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, দুরন্তপনা ও চঞ্চলতা নিয়ে মাঠে মুক্ত হাওয়ায় ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়ানোর কথা, হাসি-খুশি ভরা আনন্দ চিত্তে খেলার সাথি ও সহপাঠীদের সাথে মেতে ওঠার কথা!

আমাদের সমাজের অনেকেই ‘গৃহকর্ম’ বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নেন। অনেকে আবার মনে করে থাকেন, এই কাজটি দরিদ্র্য শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ একটি কাজ। তবে কখনো ভেবে দেখেছেন কী কোন পেশায় শিশুরা সবেচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়?

অন্য সব ধরনের কাজের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকলেও, গৃহকর্মীদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে রাত অব্দি একটানা কাজ করতে হয় তাদের। এরপর আবার কাজের একটু এদিক-ওদিক হলেই ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন ও বকাবকি শুনতে হয় এই শিশু গৃহকর্মীদের। খুন্তির ছেঁকা, পুড়িয়ে দেওয়া, চুল কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে আমাদের সমাজের তথাকথিত ভদ্র ও সুশীল মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষেরা তাদের যৌনকাজেও ব্যাবহার করে থাকেন। কিন্তু কখনো একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন কী আপনাদের এই আচরণের ফলে এই নিষ্পাপ শিশুগুলো কীভাবে অকালে ঝরে পড়ছে?

মাথার অপর ছাদ, তিন বেলা খাবার আর বছরে একটা জামা দিলেই গৃহকর্তারা ভাবেন তারা গৃহকর্মীদের অনেক কিছু ‍দিয়ে ফেলেছেন! কিন্তু এই বয়সে শিশুদের মানসিক বিকাশ এর জন্য যা সবচেয়ে বেশি গুরত্বপূর্ণ, তা থেকেই গৃহকর্তারা তাদেরকে বঞ্চিত করছেন এবং তা হলো ‘বিনোদন।’ গৃহের কাজ থেকে একটু ‍নিস্তার পেলেও সে যেন সমাজের অন্য আট-দশটা শিশুদের মতো তার এই অবসর সময়টাকে  উপভোগ করতে পারে না। কখনও দরজা বা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থেকে ‍টিভি দেখা বা গান শোনা ইত্যাদি তেমন অপরিচিত দৃশ্য নয়। এই সময়ের মধ্যেও যে তাকে এক গ্লাস পানি আনতে বা বাড়ির শিশুটির সঙ্গে খেলতে বলা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

এই বিষয়ে এতগুলো কথা বলার কারণ হলো কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর বাসার বেড়াতে গিয়ে তার বাসার শিশু গৃহকর্মীর সাথে কথা হয় আমার। বয়স দশ থেকে ১২ হবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কয়দিন ধরে এ বাসায় কাজ কর?’ সে আমাকে জানায় প্রায় ছয় মাস ধরে সে এই বাড়িতে কাজ করে এবং আগামীকাল সে তার গ্রামে চলে যাবে। হঠাৎ তার গ্রামে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে মুচকি হেসে আমাকে বলে, ‘আপা, আম্মা-আব্বার লেইগা পরান পোড়ে। রাত হইলেই কেন জানি কান্দন পায় আম্মা-আব্বার লাইগা।’

তার এই কথাগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলাম, ও হয়তো সুযোগ থাকার কারণে তার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারছে। কিন্তু ওর মতো আমাদের সমাজের অনেক শিশুরই হয়তো মা-বাবার জন্য খারাপ লাগে, তারাও হয়তো শব্দহীনভাবে কাঁদতে থাকে তাদের মা-বাবার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তারা তাদের মা-বাবার কাছে যেতে পারে না।

একটি শিশু গৃহকর্মীর জীবনে ওই দিকটাই সবচেয়ে উদ্বেগের যে, সে বিচ্ছিন্ন একটি শিশু। সে তার চেয়ে বয়স্ক, শক্তিমান ও আদেশদাতার কাছে বন্দি!

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com