রাজন হত্যা ও শিশু নির্যাতনের ইতিবৃত্ত

বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে থাকা সংবাদটি হল সিলেটে রাজন নামের এক শিশুকে 'চোর' অপবাদে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় মেরে ফেলার দৃশ্য ভিডিও করার মতো অমানবিকতাও দেখাতে পেরেছে নরপিশাচরা।

রাজনকে 'চুরির' অভিযোগে এভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচার হলেও পরে তার পরিবার জানায়, রাজনকে 'বলাৎকার' করতে চেয়েছিল এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না।

তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় চুরির নাটক সাজিয়ে রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

যদি আলোচনার খাতিরে ধরি রাজন ভ্যান চুরি করেছে, তারপরও একজন শিশুকে এভাবে নির্যাতন করা কতটা যৌক্তিক?

আমাদের দেশে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত শিশুরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে। চুরি, ছিনতাই এমনকি মানুষ হত্যার মতো কাজও করে বসে কখনও কখনও।

কিন্তু শিশু আইন অনুযায়ী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত শিশুকে শাস্তি নয় বরং সংশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মানা হচ্ছে না এটা অনেক ক্ষেত্রেই।  

শিশু অপরাধী পেলে তাকে নির্মমভাবে না পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াই মানুষের কাজ। এতে করে শিশুটি সংশোধন হওয়ার সুযোগ পাবে কিন্তু পিটিয়ে মেরে ফেলে, গুরুতর আহত করে বা মানসিক নির্যাতন করে কোন লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। এভাবে শিশু অপরাধ দমন করা যাবে না। তাই আইনের আশ্রয় নিয়ে শিশুটিকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। এভাবে আইন বহির্ভূত কোন বিচার অবশ্যই কাম্য নয়।

রাজনের মতো অনেক শিশুই এভাবে নির্যাতিত হয়। এটা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই এ ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম। চলতি বছরেই অনেক শিশু নির্যাতনের খবর আমার চোখে পড়েছে।

এ বছর জুন মাসের ২৬ তারিখে যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে আমার চোখ আটকে যায়। বাবার সঙ্গে শত্রুতার জেরে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন সদস্য অপু নামের নবম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রকে অপহরণ করে।

এরপর তাকে আটকে রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় এবং তার পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

জুন মাসেরই ২৯ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারি নওগাঁয় ৫ বছরের এক শিশুকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে তার প্রতিবেশি।

এছাড়া জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক খবর পড়ে জানতে পারি, ফেনীতে শারমিন নামে ৯ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে এক গৃহবধূ।

খুব অল্প কয়েকটি খবরের কথা বললাম। দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘাটলে এমন হাজারো শিশু নির্যাতনের খবর বেরিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি- ২০১৩ নিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ছয়টি জাতীয় পত্রিকার শিশু বিষয়ক খবর পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরটিতে ২৬৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১২ জন। গুরুতর আহত হয় ২৩৯ জন শিশু।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বছরটিতে ৯০ শিশু অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর খুন করা হয় দুজনকে। পারিবারিক কলহ, মুক্তিপণ না পেয়ে, জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও মা-বাবার পরকীয়ার জেরে ৩৩৫ শিশু খুন হয়। অশ্লীল ভিডিওচিত্র ছড়ানোর ভয়ে বা অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে ১৬৬ শিশু। বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ডে ২৪৫ শিশুকে সম্পৃক্ত করা হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১৭৬ জন। বছরটিতে পাচার হয় ৪২ শিশু। অ্যাসিডদগ্ধ হয় ১০ শিশু। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪১ শিশু মারা যায়। ১০৭ শিশু গুরুতর আহত হয়।

বারবার শিশু নির্যাতনের ঘটনার কারণ কী? দেশে তো নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠোর আইন রয়েছে। উত্তর খুব সহজ। কারণ এর কোন প্রয়োগ নেই।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দেশে প্রতি বছর হাজারো মামলা হলেও মামলায় অভিযুক্তদের সাজা পাওয়ার হার এক শতাংশেরও কম।

এখানে বলা হয়েছে দেশের তিনটি জেলায় ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৭৩টি মামলায় নিষ্পত্তি হলেও এতে সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। সাজা পাওয়ার হার মাত্র দশমিক ৯৪ শতাংশ।

এভাবে অপরাধী ছাড় পেয়ে গেলে শিশু নির্যাতন কমবে কীভাবে। শিশু নির্যাতন বন্ধে আইন প্রয়োগ করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া আজ সময়ের দাবি।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com