বরিশাল: ইতিহাস ও ঐতিহ্য (প্রথম পর্ব)

কীর্তনখোলা নদীর তীরে ধান-নদী-খালের অঞ্চল বরিশাল। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামল এই জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি জেলা ও বিভাগ।

দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলি জমে গড়ে ওঠা কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে এই অঞ্চল, নানা সময়ে নানান নামে পরিচিত ছিল।

ইতিহাসে প্রাচীন বরিশালের নামকরন ও এর ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ ধারনা পাওয়া যায়। একসময় বরিশাল ‘বাকলা’ ও ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে পরিচিত ছিল। এইসব নামকরণের কারণ ও পেক্ষাপট সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি আছে। প্রাচীন বাংলায় সমুদ্র উপকূলের চন্দ্রদ্বীপের মূলভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র ছিল বর্তমান বরিশাল জেলা। প্রাচীন এ  জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী জায়গা।

প্রাচীনকালে সাতটি শাখায় ভাগ হওয়া গঙ্গার একটি দিক ছিল পাবণী পূর্বগামী শাখা। পূর্বগামী ত্রিধারার মিলিত স্থানকে সুগন্ধা বলা হতো। এই সুগন্ধা নদীর বুকে গঙ্গার পলিমাটি নিয়ে অসংখ্য দ্বীপ সৃষ্টি হয়।  ইন্দ্রদ্বীপ, সংখকোট, স্ত্রীর, জম্বু দ্বীপ নামে  অনেক দ্বীপের  উল্লেখ পাওয়া যায় ইতিহাসে। কালের বিবর্তনে চাঁদের মতো দেখতে এই দ্বীপগুলোর সম্মিলিত নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। মতান্তরে, চন্দ্রভদ্র জনগোষ্ঠির নামানুসারে চন্দ্রদ্বীপের নাম হয়েছে।

খ্রিস্টিয়  তৃতীয় শতকের আগে বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিল বলে জানা যায়। চতুর্থ শতকে বাঁকুড়ার মহারাজা পুষ্করণ চন্দ্রবর্মা কোটালীপাড়া দখল করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে চন্দ্রদ্বীপের সভ্যতা গড়ে ওঠে। গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাটসহ সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিলো তখন।

এর কিছুদিন পর গুপ্ত বংশের সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র, গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রদ্বীপ জয় করেন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এই বংশেরই বৌন্যগুপ্ত, গুপ্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমতটে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করেন এবং  পরে চন্দ্রদ্বীপ  দখল করে নেন।

৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত  গোপালচন্দ্র, ধর্মাদিত্য, নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদেব ও সপ্তম শতাব্দিতে খড়গ বংশ, অষ্টম শতাব্দীতে দেববংশ, নবম ও দশম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশ এবং এগার থেকে চৌদ্দ শতাব্দীতে সেন বংশের শাসকেরা এই অঞ্চল শাসন করেন।

চন্দ্রদ্বীপে মুসলমানদের আগমন ঘটে পনের শতকের মধ্যভাগে।  ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান বারবাক শাহ চন্দ্রদ্বীপে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। পনের শতকের শুরুর দিকে সেন বংশের  লক্ষণ সেনের পৌত্র ধনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি চন্দ্রদ্বীপে রাজত্ব করেন। তার শাসনামলে তিনি প্রথমে বর্তমান বরিশালের হিজলার গোবিন্দপুরে ও পরে বাউফলের কচুয়ায় রাজধানী স্থাপন করেন।

ধনুজমর্দনের পরে রমাবল্লভ, কৃষ্ণবল্লভ, হরিবল্লভ, জয়দেব, বাকলার একমাত্র মহিলা রাজা কমলা রানী  ও পরমানন্দ, এই  সাত জন রাজা শাসন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ লোকের মৃত্যু হয়। সেখানকার রাজা জগদানন্দ বসুও এসময় পানিতে ডুবে মারা যান। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজা  কন্দপনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের রাজত্ব গ্রহণ করেন।

এই সময় মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় কন্দপনারায়ণ প্রথমে বাসুরীকাঠি (বর্তমানে বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) ও পরে বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে কন্দপনারায়ণ নিহত হলে তার পুত্র রামচন্দ্র সিংহাসনে বসেন।

তিনি প্রথমে ঝালকাঠির হোসেনপুরে ও পরে বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন এবং কিছুকাল রাজত্ব  করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের হাতে স্বাধীন রাজা ডরামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরে শাহ সুজা, উমেদ খান, কীর্তিনারায়ণ, উদয় নারায়্ণ প্রমুখ চন্দ্রদ্বীপ তথা বাকলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেন।

শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ দস্যুদের কঠোর হাতে দমন করেন। আঠার শতকের প্রথম দিকে বরিশালের ইতিহাসের কিংবদন্তি আগা বাকেরের আবির্ভাব ঘটে। নবাব আলিবর্দি খাঁ যখন বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেন (১৭৪০-১৭৫৬) তখন আগা বাকের সেলিমাবাদ পরগণার সাড়ে এগার আনি এবং বুজর্গ উমেদপুর সম্পূর্ণ অধিকার করেন। তার নামেই তখন এই জেলার নাম হয়েছিল বাকেরগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com