রাখালের লাঠি এখন শিক্ষকের কাঠি

সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি মোমিনুল ইসলাম। গরু চরানোর ফাঁকে ফাঁকে স্কুলের পড়া পড়তে হয়েছে তাকে। গরুর দুধ বেচতে বাজারেও যেতে হয়েছে। তবে তিনি একাজগুলোকে ছোটো করে দেখেননি। এগুলোকে বরং স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার হিসাবে দেখেছেন।

এসব কাজ করেই নিয়মিত ক্লাস করেছেন। হেরে যাননি কোনো প্রতিবন্ধকতার কাছে।

আর এভাবেই পীরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৪.৭৫ পেয়ে এবং ২০০৮ সালে পীরগঞ্জ সরকারি কলেজে মানবিক বিভাগ থেকে ৪.৫০ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ভাকুড়া গ্রামের মোমিনুল।

সেখানেই থেমে যাননি। ৩৫তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষাতেও শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।

বাবা ইউনুস আলী পেশায় একজন কৃষক আর মা জবেদা খাতুন গৃহিণী। চার ভাই-বোনের মধ্যে মোমিন তৃতীয়।

সম্প্রতি হ্যালোর মুখোমুখি হয়েছিলেন মোমিনুল। হ্যালোকে জানালেন তার জীবন সংগ্রামের গল্প।

ছোটবেলা থেকেই মোমিনুলের লেখাপড়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই পড়ার খরচ জোগাতে গরু পালন করতেন তারা। বন্ধুদের মতো তার প্রাইভেট পড়ারও সুযোগ হয়ে ওঠেনি। পাঠ্যবইই ছিল তার সম্বল। 

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রাজশাহীতে ভর্তি কোচিং করেন। সে সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেকটি বিভাগে পৃথক পৃথক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে সাতটিতে সুযোগ পেয়েছিলেন। টাকার অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে পারননি।

অর্থনীতি বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এসময় তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন তার বড় বোনের স্বামী। ২০১২ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করেন এবং ২০১৩ সালে মাস্টার্স শেষ করেন।

এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করেছেন। শেষে ২০১৫ সালে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথমবার অংশ নিয়েই টিকে যান। এর ফাঁকে সাব-ইন্সপেক্টর(এসআই) পদে পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হন। সাব-ইন্সপেক্টর পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ট্রেনিংয়ে যাওয়ার তারিখ ছিল ২০১৬ সালের ২৬ অগাস্ট।

এর মধ্যে ১৭ অগাস্ট বিসিএস-এর চূড়ান্ত ফলে শিক্ষা ক্যাডারে অর্থনীতি বিভাগে সুযোগ পান।

ছোটবেলা থেকে মোমিনুলের স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় পুলিশের ট্রেনিংয়ে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মোমিনুলের অনভূতি কেমন জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি। কষ্ট করেছি। তার সুফল পেয়েছি। গ্রামের মানুষ আগের চেয়ে এখন আমাদের পরিবারকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করে। লোকেরা আমাকে নিয়ে গল্প করে।

বিয়ের পাত্র হিসাবেও তার দাম বেড়েছে। কিন্তু মোমিন যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে চান না।

শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌতুক, বাল্যবিয়ে, মাদক এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে চান মোমিনুল।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীই লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। অনেক সুবিধাবঞ্চিত শিশুও রয়েছে। এদের নিয়ে একটা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ইচ্ছে আছে। আর নিজে পিএইচডি ডিগ্রি করতে চাই।’

তিনি জানান, এখন অনেক ব্যাংক শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে। অনেক সমাজিক সংগঠনও সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে। সুতরাং লেখাপড়া করতে এখন আর্থিক দিকটা আর তেমন সমস্যার বিষয় নয়। সৎসাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে একটা স্বপ্ন থাকতে হবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কোনো কাজকেই ছোটো করে দেখার সুযোগ নাই। তবেই সাফল্যের দেখা পাওয়া যাবে।

‘ছাত্রজীবনে আমার বিলাসিতা করার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে এখন আমি সচ্ছল কিন্তু এখনও সাধারণ জীবনযাপন করতে চাই,’ বলেন মোমিনুল।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com