সন্তানকে শ্রেষ্ঠ বানানোর জন্য মায়েরা প্রতিনিয়ত তাদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখছেন।
Published : 23 Apr 2016, 03:55 PM
ফলে নষ্ট হচ্ছে শিশুর মন, সময়, মেধা, শৈশব ও একটি সুন্দর জীবন।
কর্মজীবী বাবা মাথার ঘাম ঝরিয়ে রোজগারে দিনভর ব্যস্ত থাকেন। অফিস কিংবা সংসারে কাজ করলেও মূলত সন্তানের রুটিন দেখভাল করেন মা।
স্কুল, হোমওয়ার্ক, কোচিং, টিউটর, গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, অংকন-আবৃত্তিতে শিশুকে একটি ছক-বাঁধা রুটিনে অভ্যস্ত করা হচ্ছে।
অথচ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশু বেড়ে উঠবে আনন্দের ভেতর দিয়ে।
বনশ্রী আইডিয়ালের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র নাহিয়ান ভোর ছ'টায় ঘুম থেকে ওঠে। ধর্ম শিক্ষা বিষয়ক পড়া শেষ করে, ক্লাসের পড়া করে তবে নাস্তা করে। তারপর মায়ের সাথে স্কুলে যায়। বিকেলে ফিরে গোসল করে তারপর খাওয়া দাওয়া। মিনিট বিশেকের মধ্যে দৌড় দেয় কোচিংয়ে। বাসায় ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধ্যা। ততক্ষণে বাসার টিউটর তার অপেক্ষায় বসে আছেন।
রাত ন'টার পর ক্লান্ত দেহটি নিয়ে বিছানায় বসে নাহিয়ান হোমওয়ার্ক শেষ করে। তখন আর চেয়ার টেবিলে বসে তার পড়ার শক্তি নাই।শুক্রবার তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সে দিনের অর্ধেকটাও বরাদ্দ, কুংফু, গান ও চিত্রাংকনের জন্য।
নাহিয়ান জানায়, শুক্রবার বিকেলে সে কম্পিউটারে খানিক ক্ষণের জন্য গেমস খেলার অনুমতি পায়। কিন্তু সময়ের অভাবে কার্টুন দেখা হয় না।
বিএএফ শাহীন কলেজের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এবং এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট নইমা আক্তার বলেন, বিরামহীন রুটিন শিশুটির স্মরণশক্তিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এসব ক্ষেত্রে একটা সময় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এত কড়াকড়ির ফলে কিশোর বয়সে বিপথে যাওয়ার শংকাও থাকে।
তিনি আরও বলেন, একটা শিশুর মধ্যে ক্ষতিকর প্রতিযোগিতা কাজ করে না। সে ধরণের প্রতিযোগিতায় শিশুকে জড়াচ্ছেন খোদ মা-ই। অন্যের বাচ্চাকে দেখিয়ে বলেন, ও পারলে তুমি পারবে না কেন? এতে করে শিশুটি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রীতে দুই শিশুর মৃত্যুর খবরে মর্মাহত আর হতবাক হয়েছিল মানুষ। ১৩ মার্চ ওই শিশুদের মা ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে বলেন, সন্তানদের শিক্ষা জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা থেকেই দুই সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন।
মায়েদের এমন পরিস্থিতি নিয়ে নইমা আক্তার বলেন, কোন কোন মা মনে করেন তিনি ডাক্তার হতে পারেননি তাই যে কোনভাবে সন্তানকে ডাক্তার হতেই হবে। এটা যেন এক অসুস্থ প্রবণতা।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের কাছে অনেক অভিবাবক আসেন। তাদের অভিযোগ একটাই। বাচ্চা পড়তে চায় না। আমরা আশা করি- মা হয়ত বলবেন বাচ্চাটা বিড়ালকে লাথি মেরেছে, গরীব বাচ্চাদের ঘৃণা করছে, একটুতেই রেগে যায়- এসব অভিযোগ করবেন। অথচ মায়েরা এসব জানতেই চান না।
নইমা আক্তার পরামর্শ দিয়ে বলেন, মায়েদের উচিৎ ‘পেরেন্টিং কাউন্সিল’-এর ওয়ার্কশপগুলোতে যাওয়া। নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো শিখলে আশা করি ভালো হবে। মা যেমন শিশুটির শারীরিক যত্ন নিচ্ছেন তেমনি মানসিক যত্ন নেওয়াও তার দায়িত্ব।
নাহিয়ানের মা নাসরিন পারভিন দোষারোপ করেন বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে। এ রকম ব্যবস্থার কারণেই শিশুদের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমার সন্তান হাসি-খুশি থাকুক, খেলুক আমি তা চাই। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মসৃন, সাবলীল আর শিশু বান্ধব নয়। তাই বাধ্য হয়েই পড়ালেখা নিয়ে কঠোর হতে হচ্ছে।”
নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি মনে করেন, মায়েরাই প্রতিযোগিতায় জড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, আজকালকার বাবা মায়েরা সন্তান শ্রেণিতে প্রথম হবে কী করে এ চিন্তা নিয়েই অস্থির হয়ে থাকেন। মানুষের মতো মানুষ হবে কিনা সে চিন্তার খোঁজ নাই। যার ফলে শিশুদের ভেতর চারিত্রিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
মন্ত্রী মায়েদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে পরামর্শ দেন।