‘স্কুলে গেলে পাতে ভাত জুটবে না’ 

শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী ছেলে মেয়েদের শিশু হিসেবে ধরা হয়। আর বাংলাদেশে এদের সংখ্যা শতকরা ৪৫ ভাগ। প্রায় ৫০ লাখ শিশুই নিষিদ্ধ শিশুশ্রমজীবী হিসেবে কাজ করে।
‘স্কুলে গেলে পাতে ভাত জুটবে না’ 

মাগুরা জেলার তেরো বছর বয়সী শিশু শ্রমজীবী ইনদাদুল ইট ভাঙার কাজ করে। ও জানায়, দু বছর ধরে সে কাজ করে খায়। 

তৃতীয় শ্রেণিতে ঝরে পড়া ইনদাদের পড়তে ভালো লাগে না কারণ, স্কুলে গেলে পাতে ভাত জুটবে না।  

আকাশের মা ছেলেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে পেরেছেন। তারপর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ মাকে কাজে না পাঠিয়ে নিজেই রোজগারের পথ বেছে নিয়েছে। ইটভাটাতে কাজ করে ও।

ছোট্ট তপু সবে দশে পা দিয়েছে। কিন্তু হোটেলের থালাবাসন ধোয়া, ঝাড়ু দেয়া, টেবিল পরিষ্কার করা, মশলা বাটাসহ নানান কাজ করতে হয় তাকে।

‘বেশি কষ্ট হয় বেশ দূর থেকে পানি টেনে আনতে। পানি নিয়ে ফিরতে দেরি হলে মালিকের চড়চাপড় নৈমিত্তিক ঘটনা,’ বলে তপু।

হোটেল মালিক গৌতম পোদ্দার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ওদের কান্নাকাটিতেই কাজে নেওয়া হয়। নিয়মিত খাওয়া ও বেতন দিই আমি।’

মাগুরা থেকে ১৩ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কা গৃহকর্মী হিসেবে ঢাকা গেছে কাজ করতে। মা-বাবা ও পাঁচ ভাইবোনের সংসারের অভাব কমাতে সে গ্রাম থেকে পাড়ি জমিয়েছে রাজধানীতে, জানান ওর মা। 

প্রিয়াঙ্কা বলে, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফরমাশ খাটার পর পড়ালেখার কথা আর ভাবতে ভালো লাগে না।

‘ঢাকায় যাওয়ার আগে স্কুলের কথা চিন্তা করতাম। মনে হইতো লেখাপড়া করে বড় কোনো চাকরি করব। এখন আর সে সব মনে হয় না।’    

গৃহকর্ত্রী রত্না বিশ্বাস বলেন, ‘বড়দের রাখলে চুরি করে পালিয়ে যায়। বাড়ির কাজে ছোটরাই সুবিধাজনক।

‘ওদের দিয়ে কাজ করাতে খারাপ লাগলেও আমরা নিরুপায়।’

জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার নৈতিক, মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ক্ষতি হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, দেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুকিঁপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস ঢাকা শহরেই। সরকার ঝুকিঁপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও তা মানা হচ্ছে না।  

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রায় ৬০ লক্ষ শিশু দারিদ্র্যের কারণে শ্রমে নিযুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৫, প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মাধ্যমিকে ৪৫ দশমিক ৯২ জন মেয়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ৪৭ দশমিক ৬৭ জন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ৪৫ দশমিক ৯২ জন মাধ্যমিক শেষ করতে পারলেও বাকি ৪৫ দশমিক ৯২ জন ছাত্রী শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছেন।

মাধ্যমিকে স্তরে অষ্টম শ্রেণিতে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি এবং তা শতকরা ২১ দশমিক সাত জন। এছাড়া দশম শ্রেণিতে ১৮ দশমিক ৫২ জন মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয় বলে ব্যানবেইসের ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়।

১৯৯৯ সালে গৃহীত শিশুশ্রম কনভেনশন ১৮২, বাংলাদেশ ২০০১ সালে অনুমোদন করেছে। সেই কনভেনশন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

শুধু তাই নয়, কোনো শিশু কোন কাজের জন্য উপযুক্ত, তা পরীক্ষা করার জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেবেন।    

এমনকি কোন কোন কাজে শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না সে সম্পর্কেও বলা হয়েছে ধারা-৩৯ ও ৪০-এ। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। সুবিধাবাদী লোকজন নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই তাদের কাজে নেয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা ২৮৪-এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি, শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি পাচঁ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মাগুরা জেলা শিশু কর্মকর্তা আহাম্মেদ আল হাসান হ্যালোকে বলেন, ‘শিশুশ্রম বন্ধ জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকি। এটা বন্ধের জন্য সব কর্মকর্তা মিলে কাজ করছি। তা ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিভাবকদের শিশুশ্রমের কুফলের কথাও বলি।'

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com