হ্যালোঃ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতার কথা শুনব এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আপনাদের অবস্থার কথা শুনব। তার আগে আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কথা জানতে চাই। জন্ম, শৈশব-কৈশোর, পড়াশোনা অর্থাৎ বায়োগ্রাফিটা যদি ছোট্ট করে একটু বলেন।
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ আমার জন্ম পহেলা মে ১৯৫০ সালে। আমার বাবা মোহাম্মদ সিদ্দিক। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। যদিও এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মায়ের নাম উম্মে সালমা। মনে না পড়া শৈশবটা কেটেছে লালবাগে। আর ৭ বছর বয়সে আমরা মালিবাগের গুলবাগে চলে আসি। সিদ্ধেশ্বরী স্কুল ও কলেজেই আমি মেট্রিক, ইন্টার শেষ করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। টার্গেট মতো পড়তে না পারায় আবার সিদ্বেশ্বরী কলেজ থেকে বিএপাশ করি। ১৯৬৬ সালে মেট্রিক পাশ করি, ১৯৬৯ সালে ইন্টার আর বিএ শেষ করি ১৯৭৪ সালে। সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য পড়াশোনায় গ্যাপ হয়।
হ্যালোঃ প্রথম পতাকা বহনকারী হিসেবে আপনাকে রাষ্ট্রীয় বা দলীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কি ?
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ না। আমি রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও কোনো সম্মান পাইনি। তবে সাংগঠনিক ভাবে ‘মুজিব নগর সরকারী কর্মচারী কল্যাণ সমিতি’ আমাকে বাংলাদেশের পতাকা সর্বপ্রথম বহনকারী হিসেবে সম্মানিত করেছে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথী হিসেবে বি চৌধুরী ছিলেন আর ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফ ভাই ও ড. আনিসুজ্জামান বিশেষ অতিথী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তারাই আমাকে প্রথম সম্মানিত করেন। এরপর প্রজন্ম ঢাকা ও আমাদের মালিবাগ নামক সংগঠনও আমাকে সম্মানিত করেছে।
হ্যালোঃ বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয়টা কেমন ছিল আপনার?
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ বঙ্গবন্ধু আমাকে ১৯৬৫ সাল থেকে চিনতেন। মালিবাগে রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামিলীগের কাউন্সিলে এসে বঙ্গবন্ধু আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে দিয়ে যান। তখন থেকে রাজনীতিতে নিয়মিত হয়ে যাই আমি। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দিলেন তখন আমাদের একটা কাজ ছিল। ছয় দফার লিফলেট গোপনে মানুষের বাসায় বিলি করা ও এর পক্ষে সাক্ষর সংগ্রহ করা। এ নিয়ে আমি একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলাম, যদিও এদিনই রমনা থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাকে তুই করেই ডাকতেন। আমি উনার বাসায় যেতাম। উনি চুল টেনে দিয়ে বলতেন কিরে কেমন আছিস? এগুলো এখনও হৃদয়ে গেঁথে আছে। ৭০’র নির্বাচনে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তৎকালীন ২১ টা জেলার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি ৮/১০টা জেলায় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে গিয়েছি।
হ্যালোঃ বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কিভাবে পেলেন? পরিস্থিতি তখন কেমন হয়েছিল?
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ ১৫ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। আগের দিন সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় ককটেল ফাটানো হয়। গাজি গোলাম মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ও ছেলে বউ সুলতানার সাথে দেখা হয় সেখানে। তখন রাত আনুমানিক প্রায় ১১টার মতো বাজে। শেখ কামালের শ্বশুর বাড়ি ছিল বকশিবাজারে। গাজি ভাই একটু মজা করেই বললেন এতো রাতে তোমাদের আর বাসায় যাওয়ার দরকার কি? শ্বশুর বাড়ি চলে যাও।
শেখ কামাল বলল, “না! সারাদিন খাটাখাটুনির পর বাসায় যাই। কালকে আব্বা আসবেন, যাই ফ্রেশ ট্রেশ হতে হবে, বাসায় যাই।”
আমিও সেখান থেকে বাসায় চলে আসি। ভোরবেলা আমার ছোট বোন ডেকে বলল ভাইয়া তাড়াতাড়ি ওঠো, “বঙ্গবন্ধুরে মাইরা ফালাইছে।”
ঘুম থেকে ডাকলে আমি একটু রাগারাগি করতাম সবসময়ই। তো ঐদিনও রেগে গিয়ে বললাম, ধুরর! একটু ঘুমাতে দে তো।
এর মধ্যে আব্বা এসে বলার পর তখন জেগে উঠলাম। রেডিওতেও শুনলাম কুখ্যাত মেজর ডালিমের কণ্ঠ। আব্বা বললেন, “বাসায় থেক না।”
তখন আমি বেরিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ বাগান বাড়ি পর্যন্ত চলে গেলাম। দেখলাম লোকেও বলাবলি করছে।
পরিস্থিতি তাৎক্ষণিক উলট পালট হয়ে গেলো। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিরা তখনই তৎপরতা শুরু করে দিল। ওরা রাস্তায় নেমে এল। এলাকায় ঘাপটি মেরে থাকারাও বেরিয়ে এল। ভাবতেছিলাম যে, কোন স্থান থেকে প্রতিরোধের ডাক আসুক আমরা সেখানে যাব। আমরা তো ৬৯ সালে পাকিস্তান সামরিক জান্তার কারফিউও ভঙ্গ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম কেউ আর ডাক দিচ্ছে না। টানা দুই বছর দিনের বেলায় প্রকাশ্যে থাকতাম তবে রাতে বাড়ি থাকতাম না ভয়ে। প্রথম ছয় মাস ঢাকার বাইরে আত্মগোপনে ছিলাম। মনে হলো বিপক্ষ শক্তিরাই আবার ক্ষমতা নিয়ে নিল। কার জন্য এই মুক্তিযুদ্ধ করলাম। তখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতাম না ভয়ে। সম্মানের বিষয়টি তো ছিলই না। দিন দিন নিরাশ হয়ে যেতে থাকলাম।