আমার মেঘবালিকা ও শিক্ষাসপ্তাহ

স্কুলের তৃতীয় ঘণ্টা। আমাদের বাংলা ক্লাস চলছিল।

খানিক আগেই স্যার প্রাইভেট বন্ধ করার কুফল নিয়ে একটি বিশাল জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েছেন। এখন অভিশংসন না ম্যালনিউট্রিশন কি নিয়ে যেন কথা বলছেন। মাঝে মাঝে, "কি! ঠিক না কথাটা?" বলে হুংকার দিচ্ছেন আর আমরা সবাই 'হ্যাঁ স্যার', 'জ্বী স্যার' বলে মাথা নাড়ছি।

এমন সময় স্কুলের দপ্তরি ভাইয়ের আগমন। সোজা স্যারের টেবিলে ধপ করে বিশাল নোটিশের খাতাটা রাখলেন। শব্দে স্যার হয়তো একটু চমকে গেলেন।

খানিকবাদে সম্বিত ফিরে পেয়ে খাতাটা টেনে নিয়ে বহুবার চশমা মোছা, দুবার হাই তোলার পর স্যার যা জানালেন তা হলো, দশ বছর পর আবার জাতীয় শিক্ষাসপ্তাহ আয়োজন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। রচনা, আবৃত্তি, ক্বেরাত, লোকনৃত্য আর গানের ওপর প্রতিযোগীতা হবে। পরদিনই নাকি থানা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। 

পরদিনের ঘটনা। স্কুলে গেছি। পুরো স্কুলে যেন মেলা আরম্ভ হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অভিভাবকরাও চলে এসেছেন। শিক্ষার্থীদের কলরোল আর অভিভাবকদের উপদেশে ছাত্র-শিক্ষক সবাই অতিষ্ঠ। এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি। অবিশ্রান্ত। বৃষ্টির সাথে সাথেই চলল প্রতিযোগিতা। 

নিজের লেখা রচনা নিয়ে আমি অধিকাংশ সময়েই আশাবাদী আর উৎসাহী থাকি। এবার ছিলাম অতি উৎসাহী। আর সেজন্যই বোধহয় খাতায় নাম লিখতে ভুলে গেলাম। অনেক মায়ায় লেখা একটা রচনা কেউ পড়ে দেখলেন না। কারণ সেখানে নামই ছিল না। তাই বাদ পড়ল আমার লেখা। আমার প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়ার সাধ নেই মোটেই তবে ভেবে কষ্ট হল এতো সুন্দর লেখা কেউ পড়লেন না। আবার ভাবলাম, তাদের এতো সময় কোথায়? প্রতিযোগিতাই যেখানে মূখ্য সুন্দরের স্তুতি সেখানে মূর্খতা।

যখন বুঝলাম যে রচনায় আশা নেই তখন অন্য পথ খুঁজলাম। আমি সব সময় নিজেকে পরীক্ষায় ফেলতে চেষ্টা করি। এবারও তাই করলাম। ঝট করে কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিয়ে ফেললাম। আগে কোনদিন আবৃত্তি শিখিনি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি, মুখস্তও করি। রোমান্টিক কবিতাই ভালো লাগে বেশি।

জয় গোস্বামীর 'মেঘবালিকার জন্য রূপকথা' কবিতাটাকে আমি ভালোবাসতাম। ভালোবাসার ওপর ভর করে, বৃষ্টির জলে মেঘের স্পর্শ খুঁজে আবৃত্তি করলাম 'মেঘবালিকার জন্য রূপকথা'। দিনশেষে যখন প্রায় সন্ধ্যা তখন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা চলছে। আবৃত্তিতে আমি প্রথম হলাম। জানতাম আমি প্রথম হব। 'মেঘবালিকা' কখনো আমায় ঠকাতে পারে না।

দুদিন পরে জেলা পর্যায়ের  প্রতিযোগিতা। ইউটিউবে আবৃত্তি শুনলাম অনেকগুলো। ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে আবৃত্তি করলাম,

"তুমি কি সেই মেঘবালিকা? তুমি কি সেই?

সে বলেছে, 'মনে তো নেই, ওসব আমার মনে তো নেই.."

প্রতিযোগিতার দিন সকালে আমি তৈরি হলাম। পুরোদস্তুর ফর্মাল সাজ। হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। খবর পেলাম, আমাদের স্কুল থেকে যে দলটির সঙ্গে আমার যাওয়ার কথা ছিল সেটি কিছুক্ষণ আগে রওনা দিয়েছে।

বিষণ্ণ লাগল। আমি একলা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম, কেউ আমাকে জানালো না কেন যে ওরা চলে যাচ্ছে? ওদের কাছে তো আমার ফোন নম্বরটা ছিল। একটু পরেই মনে পড়ল এটা একটা প্রতিযোগিতা। আর এখানে একজন প্রতিযোগীকে হঠাতে পারলে তো প্লাস পয়েন্ট! এখানে তো আমি আবৃত্তিকার নই, একজন প্রতিযোগী।

কখনও একা একা এতোদূর যাইনি। তবুও রওনা দিলাম। একদল মানুষের সঙ্গে উঠে বসলাম সিএনজিতে। প্রতিযোগিতা শুরুর আধাঘণ্টা আগে আমি ভেন্যুতে পৌঁছলাম। আমাকে দেখে সবাই অবাক। সময় মতো এসেছি বলে বোধহয় কেউ খুশি হতে পারেনি।

ততক্ষণে আমার জেদ চেপে গেছে। এবার আমি মনে প্রাণে প্রতিযোগী হবোই! আবৃত্তিকার নই!

(চলবে...)

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com