ছোটবেলায় শেখা কাজী নজরুলের এই কবিতাটি জীবনে কখনও ভুলব না। এই কবিতা আমাকে শিখিয়েছে, আমাকে উঠতে হবে সবার আগে, কোনো অলসতা করা যাবে না। এ কথা মনে রেখেই চলেছি সবসময়।
তার ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’ ছড়াটি এতো ভালো লাগতো যে মাঝে মাঝে মনে হতো এটা আমাকে নিয়ে লেখা। আমি খুকী।
আমার ইট কাঠের দেয়ালে বন্দি শৈশবকে অনেক অর্থপূর্ণ করে তুলেছে তার
‘লিচু চোর’ অথবা ‘প্রভাতী’র মতো সৃষ্টিগুলো। তার ছড়ার বইয়ে অবসর সময়ে মুখ গুঁজে পড়ে থেকেছি। কি যে অসাধারণ অনুভূতি!
এসব অসাধারণ সৃষ্টির স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মদিন ২৫ মে।
ছোটবেলা থেকেই বাবা মা ও শিক্ষকদের কাছে কবি সম্পর্কে জেনেছি। কত ছোট বয়সে তিনি কত জায়গায় গিয়েছেন। আর্থিক অনটনে পড়ার সুযোগ না পেলেও তার জীবন থেমে থাকেনি। শুনেছি তিনি খুব সুন্দর গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন। লেটোর দলে যোগ দিয়ে গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছেন। ছোটবেলায় মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
জীবিকার জন্য রুটির দোকানেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। সেই রুটির দোকান থেকেই ময়মনসিংহের দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহ প্রতিভাবান কিশোর নজরুলকে নিয়ে আসেন আমাদের বাংলাদেশে, ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রামে। ভর্তি করে দেন দশ কিলোমিটার দূরের দরিরামপুর হাইস্কুলে।
কয়েকবছর আগে বাবা-মার সঙ্গে ঘুরে এসেছি কবির স্মৃতি বিজড়িত ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রাম, দারোগা বাড়ি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে কাজীর শিমলা গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে যেতে যেতে কত কিছু যে ভেবেছি! মনে হয়েছে এ পথ ধরেই হয়তো হেঁটে গেছেন আমাদের প্রিয় কবি, এখানেই হয়তো কোথাও বসে গান করতেন, ভাবতেন, বাঁশি বাজাতেন।
এই মেঠো পথ ধরে কিছু দূর যেতেই কাজী রফিজ উল্লাহ দারোগার বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল দারোগা বাড়ির বড় পুকুরটি। সেখানে একটা সাইনবোর্ডে লেখা, 'কবি এই পুকুরে সাঁতার কাটতেন।'
বন-জঙ্গলে ঘেরা গ্রামটি কবিকে কি মাতৃস্নেহ দিয়েছিল? প্রশ্ন জাগে মনে। পড়েছি হৈ হৈ করে সমবয়সীদের সাথে ছোটাছুটি করতেন তিনি। আর যখন তখন গান গেয়ে, বাঁশিতে করুণ সুর তুলে সবাইকে চমকে দিতেন।
ভারতের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রাম থেকে আসা অল্পবয়সী কিশোর নজরুল কি করে থাকতেন পরিবার ছেড়ে? গান গেয়ে, আনন্দ করেই হয়তো ভুলে থাকতেন সব দুঃখ।
দারোগা বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’র তত্ত্বাবধায়ক আমাদের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখান। সেখান থেকেই জানলাম অনেক কিছু।
আমার বাবা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ছোটবেলা থেকে তিনি নজরুলের খুব ভক্ত। তার কবিতার অনেক আবৃত্তি ও গান বাবার কাছ থেকে শোনা। কবি সম্পর্কে বেশির ভাগ তথ্য জেনেছি বাবার কাছ থেকে।
আমি নিশ্চিত কাজীর শিমলায় গেলে, কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখলে নজরুল ভক্তদের চোখ ছলছল করে উঠবে।
সেখান থেকে ঘুরে আসার পর কবির আরও অনেক কবিতা পড়েছি, জীবনী পড়েছি। তিনি সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য হাসি মুখে শত বিদ্রুপ সয়েছেন, এমনকি জেল খেটেছেন!
আজ আমাদের চারপাশে যে অন্যায়, হিংসা, হানাহানি এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে নজরুলের চেতনা ধারণ করতে হবে। আমাদের জাগতে হবে, সুন্দর সকাল আনতে হবে। এই অঙ্গীকার নিয়ে কবির জন্মদিনে তার প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।