‘যুদ্ধের কথা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি’ (ভিডিওসহ)

"আমাদের চাওয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেন সঠিক সম্মান পায়।”

মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হলে এখনো শিউরে ওঠেন ৭০ বছর বয়সী রওশন আরা বেগম। ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে যুদ্ধের সময় নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে ও তার পরিবারকে।

কিছুতেই যেন সেই নয় মাসের দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেন না মাথা থেকে। সম্প্রতি তার কাছে যুদ্ধ দিনের গল্প শুনতে চায় হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

রওশন আরা বেগমের জন্ম পিরোজপুরের স্বরুপকাঠী উপজেলার সুটিয়াকাঠী গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধর সময় আমি আমার গ্রামের বাড়িতে মানে বাবার বাড়ি ছিলাম। তবে সে সময় আমাদের কোনো সঠিক অবস্থান ছিল না। আমরা মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। এমনকি ঘরে ঠিকমতো ভাতও রান্না করতে পারতাম না।”

ভাই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মিলিটারির নজরে থাকতেন বলে রওশন আরা বলেন, “আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সে কারণে আমাদের ওপর সব সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিশেষ নজর ছিল। আমাদের অনেক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।

“তবে এত নিপীড়নের পরও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করে গেছি। যখনই সুযোগ পেয়েছি আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করেছি। নানাভাবে তাদের সাহায্য করেছি। তাদের ভাত রান্না করে দেওয়ার জন্য আমরা বিল অঞ্চলেও যেতাম। কিন্তু সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা কখনো কোনো সুযোগ সুবিধা বা সম্মান পাইনি।”

স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, “আমাদের বাড়ি ছিল নদীর পাড়ে। নদীতে যখন গানবোটে চড়ে মিলিটারি আসত সে সময় আমরা সবাই লুকিয়ে পড়তাম। আমাদের বাব-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা কে কোথায় থাকত আমরা কেউই জানতাম না।

“আমার এক দুলাভাইকে একবার মিলিটারিরা খুঁজছিল। একদিন আমরা এক সঙ্গে এক বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ মিলিটারি চলে এল। তাকে ধরে খুব মেরেছে। আমার বোন তার কোলের শিশুকে নিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়েছে। আমি ডোবার মতো একটা পুকুরে ঝাঁপ দেই। মুখে কাদা মেখে লুকিয়ে থাকি। সেদিন মিলিটারিরা অনেক নারীদের নির্যাতন করে। আমি চোখে দেখিনি তবে তাদের আর্তনাদ নিজ কানে শুনেছি।”

বয়স বেড়েছে, ঝাপসা হয়েছে জীবনের নানা স্মৃতি। কিন্তু যুদ্ধের স্মৃতি যেন জ্বলজলে রওশন আরা বেগমের।

তিনি বলে চলেছেন, “আরেক দিনের কথা। আমি উঠোনে রোদে বসেছিলাম। পাশের ছারছীনা পীরের দরবার শরীফে মিলিটারিদের ক্যাম্প। হঠাৎ করে সেখান থেকে মিলিটারিরা গুলি বর্ষণ করে। একটা গুলি এসে আমাদের দুই পায়ের মধ্যখানে পড়ে। সেই গুলির বর্ষণে আমাদের ঘর বাড়ি ঝাঁঝরা হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী একদিন আমাদের ঘরে আগুনও জ্বালিয়ে দেয়। আমার বাবা চাচা আর ভাই মিলে সে আগুন নেভায়। তারপরও আল্লাহ আমাদের মান-ইজ্জতের সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখেন।

“একদিন মিলিটারিরা এলে আমরা সবাই লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু আমার বোনের কোলে শিশু সন্তান থাকায় সে কোথাও যেতে পারেনি। সে তার বাচ্চা নিয়ে চৌকির উপর বসে থাকে। তার জামাই ঘরের উপরের মাচায় লুকিয়ে পড়ে।

“আমরা এই যে এতো রকম কষ্ট করেছি৷ আমাদের এমনও দিন গেছে যে আমরা দুই দিনেও ভাত খাইনি। আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় শুধু চাল সঙ্গে করে নিয়ে গেছি। সে চাল চুবিয়ে পানি খেয়ে দিন কাটিয়েছি। আমরা না খেয়ে অনেক কষ্ট করেছি। এখনো যুদ্ধের কথা মনে হলে আমি শিউরে উঠি। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি।

“মিলিটারির ভয়ে সারা গ্রাম তটস্ত থাকত তখন। আমরা রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতাম। আমার বাবা আমাদের শুনাতেন। কিন্তু সে ভাষণও খুব আস্তে আস্তে শুনতে হতো। ভয়ে জোরে শুনতে পারতাম না।

“আমাদের স্বরুপকাঠী ও সুটিয়াকাঠীতে মিলিটারি খুব জ্বালাতন করেছে। আমার বাবা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন তাই মিলিটারি তাকে মারার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি।

“আমাদের এখন ছেলেমেয়ে আছে, আমরা বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমাদের চাওয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেন সঠিক সম্মান পায়।”

প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: পটুয়াখালী।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com