ঈদ যেভাবে উৎসব হয়ে গেল বাংলায়
ঈদকে উৎসব হিসেবে বাংলায় ধরা দেয় মোগল আমল থেকে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লাইফ স্টাইল বিভাগে ২০১৩ সালে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ইতিহাস গবেষক রিদওয়ান আক্রাম।
তার লেখা থেকে জানা যায়, মোগলদের আগমনের আগে এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই সামান্য ছিল। তাই ঈদ নিয়ে বিশেষ কোনো উদযাপন চোখে পড়ার মতো ছিল না।
১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার প্রশাসক সুবেদার ইসলাম খাঁ এবং তার বিশাল বাহিনীর ৫০ হাজারের মতো লোক ঢাকায় প্রবেশ করে। এরমধ্য দিয়েই বলা চলে বাংলায় মুসলিমদের প্রবেশ, অর্থাৎ ঈদ উদযাপনের শুরুটা এই ৫০ হাজার জনের থেকেই।
মোগলদের ঈদের উদযাপন হতো রাজকীয়ভাবে। স্থায়ীত্ব থাকত দুই-তিনদিন বা আরো বেশি সময় ধরে। অনুমান করে নেওয়া হয় বাদশাহী বাজারে (বর্তমান চকবাজার) ঈদের মেলা আয়োজিত হতো। বিশেষ করে তখনকার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকা কেল্লার (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার) আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট।
চাঁদরাতে এখনের মতো সেসময়েও উৎসবের আমেজ শুরু হতো। সন্ধ্যা থেকেই মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে ঢাকা আলোকিত হয়ে উঠত। শিবিরে বেজে উঠত শাহী তূর্য (রণশিঙ্গা) এবং গোলন্দাজ বাহিনী গুলির মতো একের পর এক ছুঁড়তে থাকত আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত এই আতশবাজির খেলা। শেষরাতের দিকে বড় কামান দাগা হতো। ঢাকাবাসী সেসময়েও ঈদের কেনাকাটাকে উৎসবের অংশ হিসেবে চিনত। চাঁদরাতে বাদশাহী বাজারে চলত জমজমাট কেনাকাটা।
ঢাকায় এই ঈদের উৎসব সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়তে থাকে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার পুত্র শাহ সুজাকে সুবে বাংলার শাসক করে পাঠান ১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। শাহ সুজা শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনশ শিয়া পরিবার। এভাবে ঢাকায় ইসলাম ধর্মালম্বীর সংখ্যা ও ঈদ উদযাপনের জাঁকজমক দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। ১৬৪০ সালে মুসলিমদের নামাজ পড়ার জন্য ঢাকায় সাতমসজিদ রোডের ঈদগাহটি নির্মিত হয়।
ঢাকার পাশাপাশি বাংলার অন্যান্য স্থানেও ইসলাম ধর্মালম্বীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সিলেটেও সেসময়ে একটি ঈদ্গাহ নির্মাণ করা হয়। সিলেটের মোগল ফৌজদার ফরহাদ খান এটি নির্মাণ করেছিলেন। সেসময়ে সিলেটে আরো মসজিদ এবং অন্যান্য স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়।
এর মাঝে কিছু সময়ে শাসকের হাতবদল হলেও ঢাকার ঈদ উদযাপনের জৌলুস অনেকটা অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হত। ১৭৬৫ সালে ইংরেজ শাসনের শুরু হলে ঈদ ও মহরমের মিছিলের মাধ্যমে মূলত মুসলিমরা তাদের উৎসব পালন করত। এ মিছিলগুলো হতো জমজমাট এবং ঢাকায় থাকা ইউরোপীয়রাও এতে অংশ নিত। পরবর্তীতে দাঙ্গার কারণে মিছিল বন্ধ হয়ে যায়।
মোগলেরা শাসনে না থাকলেও পরিবারগুলোতে ঈদ উদযাপনের ধারা অব্যাহত ছিল। তাদের ঐতিহ্য ছিল তোরাবন্দির মাধ্যমে চল্লিশের অধিক খাবার আয়োজনের। নবাব বাড়িতেও ঈদে বিভিন্ন ধারায় আনন্দের ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যাবেলায় অন্দরমহলে হিজড়াদের দল নাচ-গানের আসর জমাত। আলো দিয়ে সাজানো হতো আহসান মঞ্জিলকে।
ঢাকার বাইরে ঈদের উদযাপন ও মুসলিমদের সংখ্যা অল্প হলেও দীর্ঘ সময় পরে গিয়ে সারা বাংলাতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিশোরগঞ্জে ১৮২৮ সালে নির্মাণ হয় বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান।
গত শতকের ত্রিশ দশক থেকে বাংলার ঈদ উদযাপনে আরো পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। ঈদের দিনে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা তারই একটি অংশ। এছাড়া ঈদের দিনে ঢাকাবাসী এবং ঢাকার বাইরের অনেকেও ঢাকায় আসতেন দর্শনীয় স্থানগুলিতে ঈদ উদযাপনের জন্য।
১৯৩১ সাল থেকে শুরু হয় নতুন আরেক ঐতিহ্যের, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গানটি ছাড়া যেন বাংলার মানুষের ঈদ শুরুই হয় না। এ ঐতিহ্য টিকে আছে আজও।
ধারায় ধারায় পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে বড় উদযাপনে রূপ নিয়েছে ঈদ। এ অঞ্চলের মুসলিমরা এখনো ঈদ উদযাপনের বিশেষ এক স্বকীয়তা ধরে রেখেছে।