নারী শক্তি জাগ্রত হোক (ভিডিওসহ)

সভ্যতার আদিকালে নারী শিক্ষা নিয়ে সমাজের আগ্রহ না থাকলেও, আধুনিক সময়ে মানুষ নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা শুধু উপলব্ধিই করেনি বরং নারীশিক্ষা প্রসারে অত্যন্ত সচেতন হয়ে পড়েছে।
নারী শক্তি জাগ্রত হোক (ভিডিওসহ)

কারণ সভ্যতার অর্ধেক অংশই যদি ঘরে বসে থাকে, তবে সভ্যতার উন্নয়ন কোনো কালেই সম্ভব নয়। তবে, এ উপলব্ধি পৃথিবীর কিছু নারীর সহায় হলেও এখনো বহু নারী শিক্ষার আলো দেখতে পায়নি। নিজেদের প্রমাণ করার হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা আশীর্বাদ, তবে আজও অনেক নারীর সেই আশীর্বাদ হতে বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে শিক্ষাই কি কেবল নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? না, শুধুমাত্র শিক্ষা নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। দরকার আরো অনেক কিছুর সংযোজন।

প্রথমেই নারী স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাক। কথায় আছে- 'স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল'। আবার সুস্থ দেহের সাথে সুস্থ মনকে সুস্বাস্থ্য বলা যায়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। নারীর পুষ্টি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, প্রজনন স্বাস্থ্যের সঠিক ধারণা পাওয়া নারীকে সুন্দর স্বাস্থ্য দিতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে ধরে রাখতে স্বাস্থ্যের কোনো বিকল্প নেই।

নারীদের বেলায় শারীরিক নির্যাতন, হয়রানীর মতো ঘটনা ঘটে থাকে; সেখানে নিজেকে বাঁচানোর এবং রুখে দাড়াঁনোর অন্যতম উপায় শারীরিক শক্তি। তাই, নারীদের নিজেদের দুর্বল ভাবলে চলবে না বরং নিয়মিত শারীরিক কসরত ও ব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে নিজ দেহ সুগঠিত করতে হবে। আয়ত্ত করতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল। যেকোনো সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসার মানসিক এবং শারীরিক প্রস্তুতিই থাকতে হবে।

একটা শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় আশ্রয় তার পরিবার। জন্মের পর থেকে শিশু পরিবারের ধ্যান-ধারণা নিয়েই বড় হয়ে উঠে। তবে, নারীদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পরিবার বিরাট বড় ভূমিকা রাখে। মেয়ে শিশুদেরকে তার পরিবারকেই আত্মনির্ভরশিলতার গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে হবে। এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাতে হবে। তাদেরকে স্বনির্ভর হতে শেখাতে হবে। মেয়েরা যদি ছোট থেকেই বঞ্চনার শিকার হয়, তবে তাদের স্বপ্ন দেখার আর সুযোগ থাকে না। ছোট থেকেই যদি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা না পায়, তবে শিক্ষা অর্জন করেও সে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। তাকে পরনির্ভর জীবনযাপন করতে হবে। যা নারীদেরকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে। পরিবারে বিশেষ করে মা-বাবাকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ছোট থেকেই স্বাধীনচেতা মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ ও পরিবেশ দুইই নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পরিবারে মায়েদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে হবে, যা মেয়েটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাজারগুণ বেশি সহায়তা করবে।

অপরদিকে, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নারীদের প্রতি সহনশীল হতে হবে। পরিবারের ছেলেদের সঠিক নৈতিক শিক্ষা দিয়ে বড় করতে হবে। নারী সহপাঠী, বান্ধবী, বোনদের প্রতি সহনশীল হতে শেখাতে হবে। গৃহ নির্যাতন, যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে পরিবারের নারীদের পাশাপাশি পুরুষকে সোচ্চার প্রতিবাদ করতে হবে।

নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রই যেই বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ তা হলো নিজেকে জানা। তবে, নারীদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নিজেকে জানা অত্যাধিক গুরুত্বপুর্ণ। নারীরা কেবল শিক্ষা অর্জন করলেই হবে না বরং নিজের ভিতরের সম্ভাবনাকে জানতে হবে। নিজের ভেতরের নারী শক্তিকে খুঁজে পেতে হবে। সেই শক্তিকে জাগ্রত করতে জানতে হবে। নিজস্ব প্রতিভার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে হবে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের পথ তৈরি করতে হবে। নিজেকে জানলে নারীরা আত্ববিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠতে পারবে। একদিকে যেমন নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত করতে হবে অপরদিকে নিজের দুর্বলতাকেও জানতে হবে।

নারীদের এক অনন্যদিক মাতৃত্ব। একজন 'মা' কঠোরতার প্রতীক। একজন 'মা' ভালোবাসার প্রতীক। একজন 'মা' কষ্ট-সহিষ্ণুতার প্রতীক। তবে, একজন মা আবেগের সাগর। পরম করুণা এবং মায়ায় ঘেরা মাতৃত্বকে কখনোই দুর্বলতার কারণ করা যাবে না। আদর-সোহাগে যেমন নমনীয় শাসনেও তেমনি কঠোর হয়ে উঠতে হবে। আবেগের ভেলায় কিংবা সংসারের জাঁতাকলে চাপা পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। সন্তানদের মানুষ করার প্রতি যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি নিজেদের প্রতিও সচেতন হতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে। নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে হবে, যা হবে একান্তই নিজস্ব।

নারীদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় হলো- আত্মনির্ভরশীলতা। শুধু চলাফেরা এবং দৈনন্দিন কাজকর্মেই আত্মনির্ভরশীল হলে চলবে না, বরং জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নেবার মতো ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগত যেকোনো সিদ্ধান্ত নারীদের নেবার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে নিজের বিবেক-বুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে অধিকতর সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। নিজের মতামতে বা সিদ্ধান্তে কোনোভাবেই অন্য কারোর প্রভাব পড়তে দেওয়া যাবে না। দরকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। নারীদের তাদের ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মানুষ হিসেবে যে ছয়টি মৌলিক অধিকার আছে, তা রক্ষায় অত্যাধিক সচেতন হতে হবে। অপরদিকে, মানসিকভাবেও স্বাধীন এবং আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। বিশেষ করে আমাদের দেশে মেয়েরা বেশিরভাগ সময় যেকোনো বিষয় তার স্বামী, বাবা, ভাইয়ের কাছে বাধা থাকে। তার চলাফেরা- গতিবিধি, অর্থব্যায় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের তত্ত্বাবধায়নে চলে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, এসব ক্ষেত্রে যথাসম্ভব অন্যের প্রভাবমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর নিজের আর্থিক সঙ্গতি থাকা জরুরি।

আমার মনে হয় নারীদেরকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের মেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। এভাবে যেকোনো অবস্থানে একজন নারী আরেকজনের পাশে থাকলে নারীরা আরো দ্রুত এগিয়ে যাবে। কথায় আছে- 'একতাই বল'।

নারীদের এগিয়ে যাওয়ায় নারীদের এবং পরিবারের পাশাপাশি দেশের সরকার এবং প্রতিটি নাগরিককেই সচেতন হতে হবে। নারীদের অধিকার রক্ষায় আরো কিছু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন- প্রতিটি বিদ্যালয়ই প্রাথমিক পর্যায় নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক মার্শাল আর্ট, কারাতে, কুংফু অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এসব প্রশিক্ষণ অবৈতনিক করা, বিদ্যালয়ে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের বাধ্যতামূলক গার্হস্থ্য অর্থনীতি পাঠদান, মেয়েদের কৃষিশিক্ষা প্রদান প্রভৃতি।

তাছাড়া, দেশের প্রতিটি নাগরিকের তার নিজ নিজ অবস্থান হতে সচেতনতামুলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কোনো ধরণের সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা ও ব্যাপক নিন্দা গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে, মিথ্যা বা ভুল কিছু আপলোড দিয়ে কোনো ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজে নারীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করা যাবে না। সরকারকে রাস্তা-ঘাটে আইনশৃঙ্খলার রক্ষার কাজ জোরদার করতে হবে। জনবহুল এলাকায় নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। দরকার হলে নাইট শিফটে রাস্তা-ঘাটে নারীদের চলাচলের সুযোগ করতে হবে। দরকারে রাস্তাঘাটে শুধুমাত্র নারীরা ব্যবহার করতে পারবে এমন পরিবহণের ব্যাবস্থা করতে হবে।

'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড'- এ কথা সঠিক হলেও, নারীদের মেরুদণ্ড শক্তিশালী করে তুলতে শুধুমাত্র শিক্ষাতে হবে না। তাই, সবার প্রথমে আয়নার দিকে তকাতে হবে। নিজের ভেতরের অপার সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে হবে। অতঃপর আত্মবিশ্বাস এমং দৃঢ়তার সাথে নারীশক্তি নিয়েই কাজে লেগে পরতে হবে। মনে রাখতে হবে- "Girls are capable of doing everything men are capable of doing. Sometimes they have more imagination than men."- Katherine Johnson.

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com