বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ (পর্ব ৬)

ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের জন্ম ১৯৪৩ সালের পহেলা মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে।
বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ (পর্ব ৬)

তার বাবার নাম মুন্সি মেহেদি হাসান ও মার নাম মুকিদুন্নেসা। ১৯৬৩ সালের মে মাসে অষ্টম শ্রেণি অধ্যয়নরত অবস্থায় সংসারের হাল ধরার জন্য যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস 'ইপিআর' এ।

ইপিআরে যোগ দিলেও তার মন পড়ে থাকতো বাড়িতে। নিয়ম করে মাকে টাকা পাঠাতেন। লিখতেন মায়ের জন্য চিঠি। ১৯৭১ সালে মুন্সি আব্দুর রউফ তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, "এখন একটু কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না৷ তার জন্য তুমি চিন্তা করো না মা, ছুটি পেলেই বাড়ি আসব। তখন ছোট বোনের বিয়ে দিব।"

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি চট্রগ্রামের ১১নং উইং এর দায়িত্বে ছিলেন। মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১নং মেশিনগান চালক ছিলেন তিনি। যুদ্ধের শুরুতে তিনি অষ্টম ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টে যোগ দেন। তাদের দায়িত্ব ছিল জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধের সৃষ্টি করা। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাশে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে।

১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল দুপুর বেলা। জলপথ ধরে এগিয়ে আসছে সাতটি স্পিডবোট এবং দুটো লঞ্চ৷ বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ঘাঁটির উদ্দেশ্য আসছে তারা। সেখানে অবস্থান করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের কোম্পানির সৈন্যরা। সাথে করে নিয়ে এসেছে স্বয়ংক্রিয় ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র। সদ্য পাকিস্তান বাহিনী ছেড়ে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটি দেখতে পেল খুব তীব্র গতিতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দুইটি স্পিড বোট ও দুইটি লঞ্চ। সেখানে রয়েছে ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার আর বেশ কিছু মেশিনগান ও রাইফেল।

প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছে এসেই পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করলো। স্পিড বোট থেকে মেশিনগান দিয়ে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে এবং লঞ্চ থেকে ছোঁড়া হচ্ছে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সে রকম কোনো অস্ত্র, গোলা বারুদ নেই।

পাক হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্য রাঙামাটি মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হারিয়ে সে স্থান দখল নেওয়া। একসময় প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার মুন্সি আব্দুর রউফ খেয়াল করলেন এইভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে সবাই মারা যাবেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পিছু হটবেন। পিছু হটার কথা শোনার পর সবাই একসাথে পিছু হটতে লাগলেন।

মুন্সি আব্দুর রউফ খেয়াল করলেন, এইভাবে পিছু হঠতে থাকলে সবাই মারা যাবেন। একজনকে কাভার হিসাবে দাঁড়িয়ে গুলি ছোঁড়া চালিয়ে যেতে হবে৷ এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। স্পিডবোটকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করতে লাগলেন। তার প্রচণ্ড গুলি বর্ষণে শত্রুপক্ষ হতভম্ব হয়ে পড়ে। এভাবেই হানাদার বাহিনীর সাতটি স্পিডবোট ডুবে যায়। লঞ্চ দুইটিও নিরাপদ দুরত্বে সরে যায় যেন মুন্সি আব্দুর রউফের ছোঁড়া গুলি তাদের শরীরে না লাগে। সেখান থেকে তারা মর্টারের গোলা বর্ষণ করা শুরু করলো। তাদের উদ্দেশ্য, মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানকে বন্ধ করে দেওয়া।

কিন্তু রউফের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না যে তিনি একা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। হঠাত একটি মর্টারের গোলা তার পরিখায় এসে পড়ে। তার হাত থেকে ছিটকে যায় মেশিনগান। ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তার আব্দুর রউফের শরীর। দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

পার্বত্য রাঙামাটি জেলার নানিয়ার চরে রিজার্ভ বাজারের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে রাঙামাটি শহরের মানুষ প্রথম জানতে পারে তার সমাধিস্থলের কথা৷ দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক আদিবাসী বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল শনাক্ত করেন৷ শনাক্তকরণের পর তার সমাধিস্থলটি বাংলাদেশ সরকার নতুনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।

এই বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার সালামতপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘রউফ নগর'। বাংলাদেশ সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছে 'বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার।'

যুদ্ধে তার অসামান্য বীরত্বের জন্য তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com