বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর (পর্ব ৫) 

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৮ মার্চ, বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুল মোতালেব হাওলাদার, মার নাম সাফিয়া বেগম।
বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর (পর্ব ৫) 

১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন ক্যাডেট হিসাবে। কমিশন (পদ্দোন্নতি) প্রাপ্তির পর ইঞ্জিনিয়ার্স কোর লাভ করেন ১৯৬৮ সালের জুন মাসে।

যুদ্ধের সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাবাকোরামে ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়ানের হয়ে 'পাকিস্তান-চীন মহাসড়ক' নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ জুন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ছুটি নেন। পাকিস্তানি সেনা ও সীমান্তরক্ষীদেরকে ফাঁকি দিয়ে ৩ জুলাই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা এবং ক্যাপ্টেন আনাম শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। প্রথমেই নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ান হেড কোয়ার্টারে যান।

এরপর সেখান থেকে দিল্লী যান, দিল্লী থেকে কলকাতায় আসেন। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এখানে তিনি ৭ নং সেক্টরের 'সাব সেক্টর কমান্ডার' হিসাবে যুক্ত হন। সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের অধীনে যুদ্ধ করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে চার জন বাঙালি সামরিক অফিসার পালিয়ে এসেছেন বলে মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় আসেন তাদের অভ্যর্থনা দিতে। এরই মধ্যে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য দায়িত্ব পান।

১০ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমের বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন৷ পরিকল্পনা করা হয় পরদিন ভারতের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ করে হানাদার বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে ফেলবে। সেই সুযোগে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করবে। কিন্তু গোলাবর্ষণ করা হয়নি। ১২ ডিসেম্বর ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। কিন্তু ব্যর্থ হন।

১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হলো আক্রমণ করার। মুকিবাহিনীর মাত্র ২০ জন যোদ্ধা মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাথে এগিয়ে গেলেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে মহানন্দা নদী পায়ে হেঁটে পার হলেন রেহাইচর এলাকা দিয়ে৷ নদী পারের পর উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করা শুরু হলো। অতর্কিত এ হামলার সাথে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাথে যোদ্ধারা আগাতে থাকলেন দক্ষিণের দিকে। পরিকল্পনা ছিল যে, এমনভাবে আক্রমণ করবেন যেন উত্তর থেকে শত্রু হত্যার সময় তারা দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করতে না পারে। সম্মুখ ও হাতাহাতির এ যুদ্ধ ক্রমেই ভয়াবহরূপ ধারণ করে।

আর মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের পাকসেনারা অক্ষত আছেন এমন সময় বিপদ সামনে আসল। বাঁধের উপর পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের কয়েকজন সৈন্য ব্যাপারটা লক্ষ্য করল৷ তারাও যোগ দিল পাকিস্তান বাহিনীর সাথে। এরপর থেকে শুরু হলো তাদের গুলিবর্ষণ। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নির্দেশ দিলেন সামনে এগিয়ে যাবার৷ এরই মাঝে একটি গুলি সরাসরি মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কপালে লাগে। সাথে সাথে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন৷

হানাদার বাহিনীর এলোপাথারি গুলির কারণে মুক্তিবাহিনী বাধ্য হন পিছু হঠতে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডুব সাঁতার কেটে তারা মেহেদীপুর মুক্তি ক্যাম্পে যান। প্রচণ্ড শীতে নদী পার হওয়ার পর তাদের অবস্থা মৃতপ্রায়। এরই মাঝে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ হবার খবর পান তারা। শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ছিনিয়ে আনলেন বিজয়। মুক্ত হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ!

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নিষ্প্রাণ দেহ নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করে সম্মাননার সাথে সমাহিত করা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ চত্বরে। মসজিদের পূর্ব আঙিনার দক্ষিণ পাশে বর্ণিল পাথরে বাঁধাই করা হয় তার কবরস্থান। এই মসজিদের দেয়ালের বাইরে নির্মিত হয়েছে তার স্মৃতিসৌধ।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সম্মানে 'মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউনিয়ন' নামকরণ করা হয়েছে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের। এছাড়াও তার গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে 'বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার'।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com