বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পর্ব- ৩)

বীরশ্রেষ্ঠদের জানি: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পর্ব- ৩)

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈতৃক বাড়ি 'মোবারক লজ' এ জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবার নাম মৌলভী আবদুস সামাদ এবং মার নাম সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। তাদের আদি নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে।

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাবলিক স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন৷ এরপর তিনি যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনী অ্যাকাডেমিতে।

১৯৬১ সালের ১৫ অগাস্ট মতিউর রহমান রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে৷ ১৯৬৪ সালে পেশোয়ারে জেট পাইলট নিযুক্ত হন৷ ১৯৬৭ সালে তিনি পদ্দোন্নতি পেয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদবী অর্জন করেন।

১৯৭১ সালে তিনি কর্মরত ছিলেন জেট ফ্লায়িং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। ২৫ মার্চের কালরাতের সময় তিনি রায়পুরের রামনগর গ্রামে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা শুরু করেন। তিনি ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী। ছুটি শেষে মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিতে যোগ দিলেও তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, এখান থেকে একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যাবেন যুদ্ধের জন্য।

পাকিস্তানের পিআইএ এর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানে কর্মরত সকল বাঙালি অফিসারদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়৷ এমনকি তাদের বিমান উড্ডয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী একাত্তরের ২০ অগাস্ট মতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে তার ছাত্র রশিদ মিনহাজ বিমান উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। রশিদ মিনহাজ বিমান স্টার্ট দিয়ে এগোতে থাকলে মতিউর রহমান হাত দেখিয়ে ইশারা দিতে থামতে বলেন। বোঝাতে চাইলেন বিমানের পাখায় সমস্যা আছে।

রশিদ মিনহাজ বিমানের 'ক্যানোপি' খুলতেই মতিউর রহমান তাকে চেতনা নাশক দ্রব্য ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। কিন্তু জ্ঞান হারাবার পূর্বে রশিদ মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলেন, "আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড!"

রশিদ মিনহাজের বলা এ কথা কন্ট্রোল টাওয়ার শুনে ফেলে এবং তাদের নির্দেশে এফ ৮৬ ও একটি হেলিকপ্টার মতিউর রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমানটিকে ধাওয়া করা শুরু করে। রাডারকে ফাঁকি দেবার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালানো শুরু করেন তিনি।

বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে ঠিক তখনই রশিদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে বাধা দিতে চেষ্টা করে। সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে বালির ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে ব্লু বার্ড-১৬৬। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। 

সেখান থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয় এবং মশরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার কবরে পাকিস্তানিরা লিখে দিয়েছিল 'গাদ্দার' বা 'বিশ্বাসঘাতক'।

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৫ জুন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পূর্ণ মর্যাদায় পুনরায় সমাহিত করা হয় ঢাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে৷

তার এ আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রামনগর গ্রামের নাম রাখা হয় ‘মতিউর নগর'। সরকারি উদ্যোগে এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে 'বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার'।

যুদ্ধে তার অসামান্য বীরত্বের জন্য তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷

Related Stories

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com