আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি পথশিশুদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছে৷ এই শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা রাস্তায় বসবাস করতে পারে৷ পথে কর্মরত শিশু বা যেসব শিশু জীবিকার জন্য তাদের দিনের বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় ব্যয় করে, তারাও পথশিশু৷ আবার রাস্তায় বসবাসরত পরিবারের শিশু বা যেসব শিশু তাদের পরিবারের সঙ্গে রাস্তায় বসবাস করে, তাদেরকেও পথশিশু হিসেবে গণ্য করা হবে।
শহরের রাস্তায় হাঁটলেই দেখা মিলে অসংখ্য পথশিশু ভিক্ষা করছে, টাকার জন্য লোকেদের হাত-পা ধরে টানাটানি করছে। তাদের একজনের সাথে কথা হয় কদিন আগে।
নাম জিজ্ঞেস করে জানা গেল ওর নাম মন্টু। রাস্তাতেই থাকে ও। তবে মাঝে মাঝে নাকি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাড়া করলে রাস্তাতেও থাকা যায় না।
যদিও জানি পড়াশোনা ওর জন্য বিলাসিতা তবুও জিজ্ঞেস করলাম পড়াশোনা করে কিনা! জানালো, পড়াশোনার সময় বা সুযোগ কিছুই তার নেই। শুধু দু’মুঠো খাবার যোগাড়েই ব্যস্ত থাকতে হয় সারাদিন।
বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই৷ কেউ বলেন ২০ লাখ৷ আবার কেউ বলেন ২৫ লাখ৷ সেদিন ডয়েচে ভেলে বাংলার একটি প্রতিবেদনে পড়ছিলাম শিশুদের নিয়ে। সেখানে সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার বরাত দিয়ে লিখেছে, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না৷ ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে৷ এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে৷ খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নৈশপ্রহরীদের দিতে হয়৷ তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়৷
অন্যদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার' হয়৷ শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ৷ সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু৷ ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়৷ আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার৷
বলা হয়ে থাকে আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেশের একটা বড় অংশের শিশুরা বিভিন্ন কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় বসবাস করছে। যাদের প্রায় সবাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এসব পথশিশুরা বিভিন্ন কারণে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পেরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যা সামাজিক নিরাপত্তাকে ব্যাহত করছে। পথশিশুদের প্রায় অর্ধেকই বিভিন্ন মাদকদ্রব গ্রহণ করছে। যা ধীরেধীরে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে পথশিশুদের দিয়ে বিভিন্ন অসৎ কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।
সবার জন্য শিক্ষা-এ লক্ষ্যে সরকার অনেক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবছর বিশাল অংকের টাকা শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা বা নারীদের জন্য শিক্ষা, বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু এসব পথশিশুদের দিকে তাকানোর কেউ নেই? আমাদের শিক্ষাখাতে পথশিশুদের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হোক। যাতে করে পথশিশুদের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করা যায়। প্রতিবছর আমাদের মাথাপিছু আয়, জিডিপির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে হিসেবে পথশিশুদের জন্য বরাদ্দ এমন বড় কোনো বিষয় বলে মনে হয় না। বরং ভবিষ্যতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসব পথশিশুরা অনেকাংশেই সহয়তা করতে পারবে। কেননা আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই পথশিশুদের অবহেলা নয়, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করুন।