১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের ডাকে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সঙ্গে সব স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। রাজশাহী জেলাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পুলিশ সদস্যদের এই একাগ্রতা সংগ্রামী জনতাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। খবরটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহী পুলিশ লাইন সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মনের মধ্যে হয়। যার ফলে রাজশাহী পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পান।
২৬ মার্চ রাজশাহী সেনানিবাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাক বাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে তার অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পন এবং অস্ত্রাগারের চাবি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ জানান। ডিআইজি মামুন মাহমুদ এতে রাজি হননি। সেদিনই পাক সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ রংপুরে পুলিশের বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ডিআইজি মামুন মাহমুদকে কৌশলে রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে নিয়ে তার ড্রাইভারসহ তাকে হত্যা করে।
২৬ মার্চ সন্ধ্যার সময় পাক সেনারা কয়েকটি ট্রাক ও পিক আপ ভ্যানে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এর প্রত্যুত্তরে পুলিশ লাইন থেকে পাক বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে গুলি বর্ষণ হতে থাকে। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে বেশ কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। পুলিশ লাইন থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হলে পাক সেনারা প্রতিরোধের মুখে আর টিকতে থাকতে পারেনি।
পুলিশ লাইনকে লক্ষ্যস্থল করে পাক সামরিক বাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পদ্মার পাড়, লক্ষ্মীপুর মোড়, ইপিআর লাইনের পাশে (বর্তমান টিভি সেন্টার) এবং রেডিও সেন্টার, গির্জা, বাঁধের ধারসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে।
সম্মুখ যুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে কাপুরুষের মতো অতর্কিত আক্রমণের জন্য তারা প্রস্তুতি নেয়। অন্যদিকে, তারা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বন্ধের জন্য মাইকে আহবান জানায়। যা ছিল তাদের কূটকৌশলের অংশ।
তদানীন্তন জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল মজিদ পাক বাহিনীর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে সম্মত হয় যে কেউ কারো ওপর আক্রমণ করবে না। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত কাপুরুষেরা ২৭ মার্চ রাতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। হাবিলদার আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।
সমস্ত রাত উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। পাক বাহিনীর দুখানা গাড়ি উল্টে যায়। সে রাতের যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়েছিল।
২৮ মার্চ সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর ও রাজশাহী জেলার তদানীন্তন এডিসি সাদা পতাকা উড়িয়ে গোলাগুলি বন্ধ করার জন্য মাইকে আহ্বান করতে থাকেন। উভয় পক্ষ থেকে গুলি বর্ষন বন্ধ হয়।
২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশ লাইনে প্রবেশ করে ভাইয়ের দোহাই দেন এবং ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ শান্তিতে সহাবস্থান করবে এই আশ্বাস দিয়ে নিজের বাহিনীসহ সেনানিবাসের দিকে চলে যান।
পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পুলিশের সদস্যরা পাক বাহিনীর মেজরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন। সামান্য কিছু সদস্য বাংকারে ডিউটিতে থেকে যান।
২৮ মার্চ দুপুরে পুলিশের সদস্যরা যখন খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন পাক বাহিনী কাপুরুষের মতো পুলিশের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়।। তারা মর্টার শেলিং ও মেশিনগান থেকে অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশ সদস্যরা প্রাথমিকভাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। বাংকারে অবস্থানরত স্বল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্যরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও একসময় তা ভেঙে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ১৮ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হয়।
পরপর দুইবার সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনী হেরে গেলে, মুখে শান্তির বার্তা নিয়ে তারা কাপুরুষের মতো অতর্কিত হামলা চালায়। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা নামমাত্র অস্ত্র নিয়ে তাদের রুখে দেয়।
নিজের জীবন উৎসর্গ করলেও কাপুরুষদের কাছে মাথানত করেনি বীরপুরুষ বাঙালি। মুক্তিযোদ্ধাদের এই মনোভাবই তাদের দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছিল। ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।
বীরপুরুষ পুলিশ, ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের এই গল্পগুলো আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। ইতিহাসের বইয়ে এগুলো চাপা পড়ে আছে। এগুলোকে আমাদের বের করে করে আনতে হবে।