বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞান লেখক, গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর এবং জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী।
Published : 18 Sep 2018, 08:14 PM
তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, অলিম্পিয়াডের সাফল্য, দেশে বিজ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি তার আহ্বান নিয়ে হ্যালোর সঙ্গে কথা হয় তার।
হ্যালো: আপনার লেখালিখির হাতেখড়ি কীভাবে হলো?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচুর বই পড়তাম। সাধারণত স্কুল-কলেজে গণিতের অনেক বিষয় থাকে যেগুলো আমরা পুরোপুরি বুঝি না। আমি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের লাইব্রেরি থেকে গণিত সম্পর্কে যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম। সেখানে ভালো ভালো ও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ ছিল। মূলত পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম। এভাবে এক পর্যায়ে ভাবলাম, লেখা শুরু করলে মন্দ হয় না!
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমি প্রথম বই লেখার কাজ শুরু করি। সেটা ছিল প্রাণের মাঝে গণিত বাজে" সিরিজের প্রথম বই, "জ্যামিতির জন্য ভালোবাসা"
হ্যালো: সামনে কী নিয়ে লেখার ইচ্ছা?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: মূলত জীববিজ্ঞান এবং গণিত এই দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে লিখতে চাই। এসবের উপরে ইংরেজিতে প্রচুর বই থাকলেও বাংলা ভাষায় তেমন নেই। আমি এটিকে সম্প্রসারিত করতে চাই। শিক্ষার্থীরা কেবল না বুঝে মুখস্ত করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে বিজ্ঞান চর্চার সম্প্রসারণ ঘটবে না।
হ্যালো: এখন আর কোন কোন কাজের সাথে যুক্ত আছেন?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আমার প্রফেশনাল কাজ হচ্ছে মূলত গবেষণা করা। সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজি (CMBT) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি। গণিত এবং জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের সাথে জড়িত আছি। এছাড়া লেখালেখি তো আছেই।
হ্যালো: এ মুহূর্তে কোনো বই লিখছেন?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: হ্যাঁ। এখন আমি ‘পপুলেশন জেনেটিক্স’ এর উপরে একটি বই লিখছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে জীবের মধ্যে জৈবিক পরিবর্তন আসে তার উপর একটি গবেষণামূলক অথচ জনপ্রিয় বিজ্ঞান ধাঁচের একটি বই। এর উপর কিছু গাণিতিক মডেল আছে, যা বেশ ইন্টারেস্টিং। যদিও জৈব অভিব্যক্তির আধুনিক তত্ত্ব ভালোভাবে বুঝতে হলে জীববিজ্ঞানের পাশাপাশি উচ্চতর গণিত, বিশেষ করে ক্যালকুলাস জানা প্রয়োজন, তবু চেষ্টা করছি সহজভাবে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লিখতে।
হ্যালো: গণিত এবং জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, চিকিৎসা, রিসার্চ তারপরে আবার লেখালেখি -এত কাজ একসাথে কিভাবে সামলান?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: এটা আসলে আমার চারপাশে যারা থাকে তারাই ভাল বুঝতে পারে। আমি অন্যদের থেকে প্রচুর সাহায্য পাই। এছাড়া কাজগুলোকে আমি দায়িত্ব হিসেবে না ভেবে ভালোবেসে শখের বসে করি। এতে করে মানসিক চাপ অনেকটা হ্রাস পায়।
হ্যালো: অলিম্পিয়াডে আপনার কাজ সম্পর্কে জানতে চাই!
সৌমিত্র চক্রবর্তী: প্রথম প্রথম প্রচুর কাজ করতে হতো। প্রশ্ন তৈরি, মাঠ পর্যায়ে কাজ, স্পন্সর জোগাড় করা। কিন্তু এখন কাজগুলো বেশ গুছিয়ে আনতে পেরেছি। কাজেই এখন চাপ অনেকটাই কম। আমাদের খুব ভালো একটি টিম রয়েছে, যারা নিজেদের তাগিদে কাজগুলো করে।
হ্যালো: অলিম্পিয়াডে বাচ্চাদের সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আসলে গণিত অলিম্পিয়াড অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে হচ্ছে। তবে জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড মাত্র শুরু করলাম। আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণের সবে তিন বছর হয়েছে। বাচ্চারা বেশ ভালোই সাড়া দিচ্ছে এবং অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অলিম্পিয়াডকে আমরা কখনোই পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করি না। আমরা সবার মাঝে একটি উৎসবের আমেজ ছড়াই, যাতে করে তারা বিজ্ঞানের প্রতি আরো আগ্রহী হয়।
হ্যালো: আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অদ্বিতীয় নাগ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্রোঞ্জ পদক পেল, আপনিতো এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- কেমন লাগছে এই সাফল্যে?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আমরা আশাবাদী ছিলাম খুব তাড়াতাড়ি একটা সাফল্য আসবে। কিন্তু তা যে এবারই হবে, আশা করিনি। প্রতিবারই দেখা যেত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দলের ছেলেমেয়েরা প্রশ্নের ধাঁচের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে তারা বেশ নার্ভাস হয়ে যেত। তাই জানা প্রশ্নের উত্তর করতে পারত না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হয়েছে, `অদ্বিতীয়’ বেশ ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। তাছাড়া আমাদের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (NIB) থেকে তাদেরকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল, যা কাজে এসেছে।
হ্যালো: আপনার কিশোর জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সৌমিত্র চক্রবর্তী: সেরকম স্মরণীয় কোনো ঘটনা নেই। অন্য দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মতোই সাধারণভাবে বড় হয়েছি। তবে আমার বাবা-মা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে আমায় উৎসাহিত করতেন। এখন পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি, ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়াটা আমার জন্যে বেশ পজিটিভ ছিল।
হ্যালো: তখন কোন ধরণের বই পড়তে ভাল লাগত?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: সায়েন্স ফিকশন আর কমিক। এছাড়া গণিত বিষয়ক বই।
হ্যালো: অবসর সময়ে কী করা হয়?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: অবসর সময় খুব বেশি পাই না। অবসরে অলিম্পিয়াড নিয়েই কাজ করি। এছাড়া সময় পেলে বই পড়ি, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং চর্চা করি আর মাঝেমধ্যে ছবি আঁকি।
হ্যালো: আপনার লেখা মোট বইয়ের সংখ্যা কয়টি?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: সব মিলিয়ে হিসেব করলে ১৫টি। এর মধ্যে কোনোটা পুরোপুরি আমার রচনা, কোনোটায় আমার লেখা অধ্যায় রয়েছে আর কোনোটা আমার সম্পাদিত।
হ্যালো: একজন ডাক্তার গণিতে আগ্রহী, আমাদের দেশে সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। কিন্তু আপনি এর ব্যতিক্রম!
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আমার কাছে এমনটা কখনো মনে হয় নি। আমার কাছে জীববিজ্ঞান পড়তে যেমন ভালো লাগত, তেমনি গণিত, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং দর্শন চর্চা করতেও ভাল লাগত। অনেক কিছুই আমার কাছে ভালো লাগে। এটা একটা খারাপ দিক! এজন্যে সহজে কোনো দিকে ফোকাস করা যায় না।
হ্যালো: জীববিজ্ঞান এবং গণিত, কোন বিষয়ে লিখতে বেশি ভাল লাগে?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আসলে এভাবে বলা বেশ মুশকিল। দুটি বিষয়ই যেখানে আছে, সেটাই আমার কাছে ভালো লাগে। গণিত ছাড়া বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ই এগুতে পারে না।
হ্যালো: আপনার কোনো স্বপ্ন আছে যা বাস্তবায়ন করতে পারেননি বা করতে চান?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: মানুষের জীবনে অনেক ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে। এটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চিন্তার সম্প্রসারণ হোক, তারা বিজ্ঞানপ্রেমী হোক (আর্টস বা অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে না)। ছেলে-মেয়েরা যাতে বুঝে আনন্দের সাথে বিজ্ঞান শিখতে পারে, এটাই চাই।
হ্যালো: সামনে কী করার ইচ্ছা?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: গবেষণা, ক্যারিয়ার ডেভেলপ করা, অলিম্পিয়াডগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করা; এসব আরো ভালোভাবে করতে চাই।
হ্যালো: বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের দেশ অনেকটা পিছিয়ে, সামান্য অগ্রগতি হলেও আশানুরূপ নয়...
সৌমিত্র চক্রবর্তী: আসলে বিজ্ঞানচর্চার বিষয়টা একটা সামাজিক আন্দোলনের বিষয়। গুটিকয়েক মানুষ কেবল গবেষণা করলেই বিজ্ঞানচর্চা হয় না। অনেকেই বলে বাজেট বরাদ্দ হয় না, আসলে এর দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের। আর জনপ্রতিনিধিরা তো জনগণের থেকেই উঠে আসেন। তাই সবার আগে দরকার সাধারণ পাঠকের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা জাগ্রত করা। জনগণ যদি বিজ্ঞানপ্রেমী না হয়, তাহলে জনপ্রতিনিধিদের তো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না বিজ্ঞানে বাজেট বরাদ্দ করার পেছনে। ফলে বিজ্ঞানচর্চার সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আমাদের দেশে পরিবর্তন হচ্ছে। উন্নতির জন্যে আরো অনেক সময় লাগবে।
হ্যালো: শিক্ষার্থীরা গণিতে ভয় পায়, কারণটা কি?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: দোষটা আসলে আমাদের। আমরা তাদের সহজ করে শিখাতে পারি না। এজন্য মানসম্পন্ন বই এবং শিক্ষক দুটোর খুব প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, না বুঝে কোনো বিষয়ই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যেখানে খটকা লাগবে, প্রশ্ন করতে হবে। একটু বিদ্রোহী হতে হবে, নাম্বার পাওয়ার পেছনে ছুটলে হবে না। আগ্রহ নিয়ে বিষয়গুলো শিখতে হবে।
হ্যালো: তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
সৌমিত্র চক্রবর্তী: অনেক পড়তে হবে। এটার বিকল্প নেই। একটা বই লেখার পূর্বে একশটা বই পড়তে হবে।