রুদ্রর প্রয়াণ দিবসে (ভিডিওসহ)

দ্রোহ, দেশপ্রেম, সমাজ বিপ্লব নিয়ে সময়ের কাব্যিক মানুষদের নাম উচ্চারণ করলেই যার নাম উচ্চারণ করতে হয় তার নাম রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।
রুদ্রর প্রয়াণ দিবসে (ভিডিওসহ)

মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবি স্বীকৃতি।

অকাল প্রয়াত এই কবি তার কাব্যযাত্রায় ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। সাহস ও স্বপ্নে, শিল্প ও সংগ্রামে আপদমস্তক সমর্পিত এই কবি তার জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারুণ্যের দীপ্র সড়কে।

নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে, হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই কণ্ঠস্বর।

‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’– এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন- ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই।’

যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীকে। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।

মাত্র ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।

রুদ্র স্মৃতি সংসদের সভাপতি ও কবির ছোট ভাই সুমেল সারাফাতের লেখা তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করতেন রুদ্র।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন মামাতো ভাইদের সঙ্গে নিয়ে নানীর ট্রাংক থেকে টাকা চুরি করে গড়ে তোলেন “বনফুল” নামের লাইব্রেরি।

এ সময় থেকেই তিনি কাঁচা হাতে লিখতে শুরু করেছেন। খেলাধুলার খুব আগ্রহ। ভালো খেলেন। তার কিশোর বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেন মোংলার প্রথম ক্রিকেট দল।

উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান। কিশোর শহিদুল্লাহ যোগ দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের কর্মসূচিতে। হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নেন।

পরের বছর ‘কালো টাইয়ের ফাঁস’ নাটকে অভিনয় করেন। ভাইবোন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে অভিনীত এ নাটকের নির্দেশকও ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। শহিদুল্লাহ তখন মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্র। অস্থির হয়ে ওঠেন যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য। কিন্তু তার বাবাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে গেলে মা প্রথম সন্তান শহিদুল্লাহকে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দেননি। যুদ্ধে যেতে না পারার বেদনা, সেই সঙ্গে চারপাশের ধ্বংসযজ্ঞ, দেশব্যাপী পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতন তার ভাবনা জগৎকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করে। পিতার আকাঙ্খা ছিল শহিদুল্লাহ ডাক্তার হবে। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত শহিদুল্লাহরও স্বপ্ন ছিল তাই। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশে  তার স্বপ্নের পটভূমি বদলে দেয়।

দেশ স্বাধীন হলে ঢাকা এসে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে। থাকতেন ৫০ লালবাগে, সেজমামার বাসায়। এ সময় থেকেই নিয়মিতভাবে কবিতা, গান, গল্প ও নাটক লিখতে শুরু করেন।

এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনে মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামের সঙ্গে যুক্ত করেন ‘রুদ্র’। হয়ে যান রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।

চার বিষয়ে লেটার মার্কসসহ এসএসসিতে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এইচএসসিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন ঢাকা কলেজে।

১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে ‘লেখক ইউনিয়ন’- এর যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন।

পরের বছর ২৯ জানুয়ারি বিয়ে করেন নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। এ বছরের ফ্রেব্রুয়ারিতে দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’।

‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘মুনির চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ পান তিনি। ১৯৮২ সালে  ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে ৪২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গঠিত হয় ‘সংগ্রামী সাংস্কৃতিক জোট’। পরবর্তীকালে এটি ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। রুদ্র ছিলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও আহবায়ক কমিটির সদস্য।

১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘শঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা’ শ্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব’। স্বৈরাচারী সরকারের ‘এশীয় কবিতা উৎসব’ এর প্রতিবাদে আয়োজন করা হয় এ উৎসবের। এতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন রুদ্র। তিনি কার্যনির্বাহী পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। উৎসবের উদ্বোধনী সঙ্গীতটিও (শৃংখল মুক্তির জন্যে কবিতা আজ) লেখেন তিনি।

১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় জাতীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পরিষদের নেতৃবৃন্দের কয়েক জনের সঙ্গে মতবিরোধ দেখাদেয়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত জাতীয় কবিতা পরিষদের ভেতরও স্বৈরাচারী প্রক্রিয়া ঢুকে পড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে মঞ্চে কবিতা পাঠ করেন। ফলে মতবিরোধ তীব্র আকার ধারন করে। সৃষ্টি হয় পারস্পারিক দুরত্ব। অভিমানে, ক্ষোভে রুদ্র নিজেকে গুটিয়ে নেন প্রিয় সংগঠন থেকে।

সে বছরই মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’।

১৯৮৯ সাল থেকে গান রচনা ও সুরারোপে আত্ম নিয়োগ করেন। তার বিখ্যাত ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি এসময়ে লেখা। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে এ গানটির জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরনোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন।

গ্রামের বাড়ি মিঠেখালীতে গোলাম মহম্মদ, আবু জগলুল মজ্ঞু, মাহে আলম, ফারুক হোসেন, নাজমুল হক প্রমুখককে নিয়ে গড়ে তোলে গানের সংগঠন ‘অন্তর বাজাও’। মিঠেখালিতে প্রতিষ্ঠা করেন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন ‘অগ্রদূত ক্রীড়া চক্র’।

এ মহান মানুষটি ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রয়াণ দিবসে তাকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com