ট্রাফিক জ্যাম কিন্তু বিরক্তিকর না!

ট্রাফিক জ্যাম সম্পর্কে বাজে ধারনা নেই এমন মানুষ খুব কমই আছে। প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামের কারণে আমাদের প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিনা!
ট্রাফিক জ্যাম কিন্তু বিরক্তিকর না!

এটা সত্যি যে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমাদেরকে হর-হামেশা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

যাহোক আমরা এই জ্যাম নিয়ে কখনো মন খারাপ করছি, বিরক্ত হচ্ছি, মেজাজ খারাপ করছি, সরকারকে অথবা সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করছি। আমার মতে, এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল, যে সবসময় আমরা অন্যদের দোষারোপ করি।

এখন একটা সমস্যার সম্মুখীন যেহেতু আমাদের হতে হচ্ছে, সমস্যার অংশ না হয়ে সমাধানের অংশ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিন্তু চেষ্টা করছে ট্রাফিক জ্যাম প্রতিরোধ করার। তবে বেশ কিছু সমস্যার কারণে সেটা অনেকাংশেই সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই এভাবে একরোখা দোষারোপ করা উচিত হবে কি না জানি না, কিন্ত অবস্থার উন্নতি যে হবে না তা নিশ্চিত।

আমি ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা অবস্থায় দেখেছি যে দুই শ্রেণির মানুষ থাকে- একদল কেবল বিরক্তি, অবসাদ আর সরকারকে দোষারোপ করে। অন্যদিকে অপর দল এই সময়টিকে কাজে লাগায়। তারা বই পড়ে, অডিও বুক শোনে, সারা দিনের প্লানিং করে-মোট কথা সময়কে কাজে লাগায়। অপচয়ের হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু এই দুই শ্রেণির মধ্যে প্রথম দলে মানুষের সংখ্যা বেশি আর দ্বিতীয় দল সংখ্যালঘু। দিন শেষে দেখা যায় সংখ্যালঘু দলই সফল এবং প্রাণবন্ত থাকে। কাজেই আমার কাছে মনে হয় সংখ্যালঘু দলে অন্তর্ভুক্ত না হতে পারলে জীবন বৃথা। কেননা, প্রত্যেকেই জানে যে, সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। অর্থাৎ জীবনের এক একটি মুহূর্ত অতি প্রয়োজনীয়। আমাদের উচিত হবে না সেই মূল্যবান সময় নষ্ট করা।

আমি জ্যামে বসে সময়টাকে কাজে লাগানর চেষ্টা করি। বই পড়ি। বই হচ্ছে পৃথিবীর সবচয়ে বড় বিনোদন মাধ্যম। পৃথিবীর সব জ্ঞানী-গুনী মানুষরা বইকে ভালোবাসে। টিভি দেখলে সময় নষ্ট হয়, ফেইসবুক চালালে হয়। কিন্তু বই পড়লে সময় নষ্ট হয় কিংবা কিছু শেখা যায় না, এমন কথা কেউ বলতে পারবে না।

আমরা হয়তো সারাদিনের কাজের চাপে, ক্লাসের পড়ার বোঝায় হাঁপিয়ে উঠি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ডিটেকটিভ স্টোরি, সায়েন্স ফিকশন পড়ার সময়ই যেন ওঠে না! তাই জীবনটা বিষণ্ন, অবসাদগ্রস্ত আর মনমরা হয়ে যায়। সুতরাং যখন আমরা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকি, তখন আমরা বই পড়ে একইসাথে বিনোদন আর জ্ঞান অর্জন করতে পারি।

অনেকের হয়তো বই পড়তে ইচ্ছা করে না বা বাসের মধ্যে  একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে বসে পড়তে অস্বস্তি লাগে। হ্যাঁ এটাও সত্যি যে ঢাকা শহরের বাস মিনিটে মিনিটে ত্বরণ পাল্টায় (বেগ পরিবর্তন)। কাজেই তখন বই পড়া ব্রেইন ও চোখের জন্য কিছুটা ক্ষতিকর হবে। সেক্ষেত্রে আমরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে অডিও বুক শুনতে পারি। একইসাথে বাইরের নয়েজ, জ্যামে বসে থাকার বিরক্তি দুটো থেকেই মুক্তি পাওয়া যাবে। ইন্টারনেটে কেবল অডিও বুক লিখে সার্চ করলে হাজার হাজার বই পাওয়া যাবে। সেখান থেকে নিজের পছন্দমাফিক বই ডাউনলোড করে নিলেই হলো।

ট্রাফিক জ্যামে থাকাকালীন আমরা সারাদিন কী কী করলাম, সেগুলো ভাবতে পারি। নিজের সাথে নিজে কথা বলতে পারি। নিজের দর্শনকে আরও উন্নত করতে পারি। অর্থাৎ সারাদিন কার সাথে কিভাবে কথা বললাম, কোনটা ভুল হলো, কোনটা ঠিক ছিলো সেগুলো ভেবে নিজেকে শুধরে নিতে পারি।

পাশাপাশি দিনের অবশিষ্ট সময়ে আমি কী কী করবো তার একটা ক্ষুদ্র পরিকল্পনাও করা যেতে পারে। এভাবে কাজ করলে কাজগুলো গুছিয়ে করা যায়।

এবার আসি গানের কথায়। এখন অনেকেই এটা করে। জ্যামে বসে থাকা সময় গান শোনে। পাশাপাশি কবিতাও শোনা যেতে পারে। ইউটিউবে প্রচুর কবিতা আবৃত্তি করা থাকে। সেগুলো ডাউনলোড বা সরাসরি সেখান থেকেই শোনা যেতে পারে। তবে আবৃত্তি কারকের দিকে একটু নজর দেঅয়া উচিত। সব আবৃত্তি ভালো হয় না। আমার কাছে মেধা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিষ চক্রবর্তী ও সৌমিত্র চ্যাটার্জির আবৃত্তি অনেক ভালো লাগে।

সাম্প্রতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যে ইংরেজি শেখা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের কারোরই অজানা না। পাশাপাশি, পানি ছাড়া যেমন জীবন বাঁচে না, ভোকাবুলারি ছাড়া ইংরেজিতে ভালো করা অসম্ভব। কাজেই জ্যামের মধ্যে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে শেখা যেতে পারে ইংরেজি শব্দ। যদি কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে পড়া হয় তবে ব্যাপারটা মন্দ হয় না।

একজন সচেতন মানুষ হতে হলে প্রতিদিনের খবরাখবর জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্য খবরের কাগজ পড়ার কোনো বিকল্প নেই। সকাল বেলা স্কুল, দুপুরের পর প্রাইভেট, বিকালে খেলাধুলা, রাতে স্কুল-প্রাইভেটের পড়া কমপ্লিট করা। দিন শেষে যেন সময়ই বাঁচে না! আর সেজন্যই জ্যামে বসে থাকার সময়ে নিউজপেপার পড়া যায়। হাতে যদি স্মার্টফোন থাকে তবে ইন্টারনেট থেকে, কিংবা হকারের কাছ থেকে কিনে পড়া যায়।

সুতরাং জ্যামে বসে থাকা সময়কে যদি আমরা এভাবে কাজে লাগাই, তবে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় বেঁচে যাবে। সফল হতে চাইলে সময়ের মূল্য দেয়া উচিত এবং জীবনকে উপভোগ করা চাই। বিষণ্ণতা, অবসাদগ্রস্ততা, মনমরা কিংবা একঘেঁয়েমি জীবন থেকে বেরিয়ে এসে হাসিখুশি ভাবে কাজ করা দরকার। তবেই তো আমরাও হতে পারবো সেই সফল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত!

আর হ্যাঁ, ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার কারণে কখনো টিচারকে বা অন্য কাউকে মিথ্যা অজুহাত দেয়া ঠিক হবে না। বরং দেরি হওয়ার কারণে নিজেকে দোষারোপ করা উচিত যে কেন আমি আর একটু আগে বাসা থেকে বের হলাম না।

সবশেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেই কথাটি, "কাজের কারণে আমরা কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়ি না, আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি দুশ্চিন্তা, বিরক্তি আর হতাশার কারণে।" আশা করি এখন থেকে ট্রাফিক জ্যামকে আর বিরক্তিকর লাগবে না। সবার জন্য শুভ কামনা রইল। 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com