রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতরা কোনো চলচ্চিত্রের নায়ক নন। নন কোনো রূপকথার গল্পের সাহসী চরিত্র। আমাদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া তাদের দেহ, বাঙালি। কিন্তু সাহসিকতার দিক দিয়ে অন্য সবার চাইতে আলাদা। তাদের জন্যই আমরা এখন বাংলায় কথা বলি, গান গাই।
সেদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১০ জন নিয়ে একটি করে দল বানানো হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু হবে মিছিল। প্রথমে পুলিশ শুরু করে গ্রেপ্তার। তারপর লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস। এক সময় ধেয়ে আসে গুলি। একের পর এক বুলেট এসে বিদ্ধ করে বরকত, রফিক, জব্বার, সালামের দেহ।
সালাম ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। জন্ম ১৯২৫ সালে ফেনীর দাগণভুঞায়। পার হতে পারেননি স্কুলের চৌকাঠ। অর্থের অভাবে পড়ালেখা থেমেছে নবম শ্রেণিতে। এরপর আসেন ঢাকায়। চাকরি নেন শিল্প অধিদপ্তরে।
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সালাম। ঢাকা মেডিকেলের বিছানায় মৃত্যুর সাথে লড়েছেন প্রায় দেড় মাস। সেই লড়াইয়ে হেরে পৃথিবী ত্যাগ করেছেন ৭ এপ্রিল।
আবুল বরকতের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৭ জুন পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৮ সালে এসে পড়েন পূর্ব বাংলায়। পড়াশোনা করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৫২ সালে বরকত ছিলেন ২৫ বছর বয়সী তরুণ।
১৯৫১ সালে বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বায়ান্নতে স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
গুলি লাগার পর লুটিয়ে পড়েছিলেন পিচঢালা রাস্তায়। হাসপাতালে নেওয়া হলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা কাজ করতেন ছাপাখানায়। পড়াশোনার পাশাপাশি রফিক বাবাকেও সহায়তা করতেন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যখন দেশের বাতাস গরম তখন বিয়ে ঠিক হলো রফিকের। নতুন জীবনটা আর শুরু করা হয়নি তার। কেনাকাটার জন্য ঢাকায় এসে শোনেন মিছিলের কথা। যোগ দেন সেখানে। গুলি এসে আঘাত করে মাথায়। নিথর দেহ পড়ে থাকে রাস্তায়, মগজ পিষ্ট হয়ে যায় কংক্রিটের রাস্তার সাথে।
গফরগাঁওয়ের আবদুল জব্বার ছিলেন দলছুট স্বভাবের। ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অর্থের অভাবে পড়ালেখার সমাপ্তি পঞ্চম শ্রেণিতে।
বাড়ি ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল তার স্বভাব। ঘটনাক্রমে একবার নারায়ণগঞ্জ আসেন তিনি। সেখানে এক ইংরেজের সাথে পরিচয় ঘটে। তার সূত্র ধরে মায়ানমারে যান। প্রায় দশ বছর সেখানে একটি চাকরি করেন।
দেশে ফিরে বিয়ে করেন। অসুস্থ শ্বাশুড়ীর চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা। একুশের সেই মিছিলে শরীক হয়েছিলেন তিনিও। পুলিশের গুলিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু ঘটে তার।
ভাই হারানোর শোকে ২২ তারিখ বিক্ষোভ আর শোকযাত্রা করেছিল ছাত্ররা। পুলিশ গুলি চালায় সেখানেও। মারা যান শফিউর রহমান ও রিকশা চালক আউয়াল। পরবর্তী দিনের পত্রিকার খবর থেকে জানা যায় কিশোর অহিউল্লার মৃত্যুর খবর।
বৃটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তান মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রণাথ দত্ত প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তখনকার গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও বলেছিলেন, “উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে না না করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
যতবারই বাংলাকে বাতিলের কথা বলা হয়েছে বাঙালি জনতা ফুঁসে উঠেছে ততবারই। নিজ ভাষার জন্য দিয়েছে জীবন বিসর্জন।