রক্তে কেনা বাংলা

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়। আমি দাম দিয়েছি রক্ত দিয়ে। গোটা বিশ্বের ইতিহাসে আমরা প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি।
রক্তে কেনা বাংলা

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেয়। এরপর ভারতীয় উপমহাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ১৪ এবং ১৫ অগাস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।

তার মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আরো দুটি অঞ্চলে ভাগ হয়। নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান)।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন তিনি। জিন্নাহ যেখানে স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা"।

যদিও তখন শতকরা সাত শতাংশ মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলতো আর বাংলায় কথা বলতো ৫৪ শতাংশ। দ্বিগুণেরও বেশি ছিল উর্দু ও বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যার তফাৎ।

জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ। তবে জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরণের বক্তব্য দেন। এই দিনেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেনএবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বের অবস্থানের কথাই বহাল রাখেন।

এরপর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে পূর্ব বাংলার জনগণ। চার বছরে পাকাপোক্ত হয়ে এই দাবি জনরোষে পরিণত হয়।

আন্দোলন দমাতে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। ঢাকা শহরে নিষিদ্ধ করা হয় মিছিলসহ সব ধরনের সভা সমাবেশ। গ্রেফতার করা হয় একের পর এক ছাত্র নেতাকে।

পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জমায়েত হতে থাকে ছাত্ররা। বেলা ১২ টা থেকে ৩টার মধ্যে ঘটে ছাত্রদের সাহসের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। তারা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরপরই মিছিল নিয়ে রওনা হয় পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে।

এ সময় হঠাৎ করেই লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে পুলিশ। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যান। পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন আব্দুস সালাম। নাম না জানা আরো অনেকেই প্রাণ দেন এই ভাষার জন্য।

পুলিশের সাথে ছাত্রদের তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয়। গুলিবর্ষণের খবর ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিকেল চারটার দিকে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে। টনক নাড়িয়ে দেয় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের।

গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে চার বছরের মাথায় ১৯৫৬ সালে, সংবিধানে বাংলা ভাষাকেই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তারা। পৃথিবীর বুকে রচিত হয় এক ভিন্ন রচনা।

বাঙালি পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। ভাষার প্রতি বাঙালির এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বাংলাদেশের মহান শহীদ ও মাতৃভাষা দিবস পুরো বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ভাষা শহীদদের স্মরণে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয় শহীদ মিনারে। খালি পায়ে প্রভাত ফেরিসহ কালো ব্যাচ ধারণ করা হয়। এদিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com