হিন্দু কলেজে পড়ার সময়েই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। এ সময় থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিলেত যাওয়ার। তার ধারণা ছিল সেখানে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে। এ সময় বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, মধুসূদনের বিয়ে ঠিক করলে ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তখন থেকে তর নামের আগে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। হিন্দু কলেজে খ্রিস্টানদের পড়া নিষিদ্ধ থাকায় মধুসূদনকে কলেজ ছেড়ে দিতে হয়। ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপস কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত সেখানেই পড়েন। এখানে তিনি ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা শেখার সুযোগ পান।
অন্য ধর্ম গ্রহণ করায় মধুসূদন তার আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার বাবও এক সময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। অগত্যা মধুসূদন ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে এবং পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখানেই তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি পান। প্রথমে রেবেকা ও পরে হেনরিয়েটার সঙ্গে তার বিয়ে এখানেই হয়। মাদ্রাজে বসেই তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা শেখেন।
রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন এবং তার মধ্যে তখন বাংলায় নাটক লেখার সংকল্প জাগে। এই ইচ্ছা থেকেই তিনি কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তখন নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পা দেন। তিনি মহাভারতের ‘দেবযানী-যযাতি কাহিনী’ অবলম্বনে ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক এবং সেই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার।
পরের বছর মধুসূদন রচনা করেন দুটি প্রহসন- ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। প্রথমটিতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন লাম্পট্য তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
শেষ পর্যন্ত ১৮৬২ সালের ৯ জুন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে মধুসূদন বিলেত যান। সেখান থেকে ১৮৬৩ সালে তিনি প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান। এখানে বসেই তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এটিও এক নতুন সৃষ্টি। এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিল না।
ভার্সাই নগরীতে থেকেই তিনি যেন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে এবং একান্ত আপনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারেন, যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ ইত্যাদি সনেটে। তার এই সনেটগুলি ১৮৬৬ সালে ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়।
হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে ১৮৭১ সালে তিনি রচনা করেন ‘হেক্টরবধ’। আর তার শেষ রচনা ‘মায়াকানন’ (নাটক)। বাংলা ভাষায় ১২টি এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ রয়েছে।
এই কবির শেষজীবন কেটেছে খুব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে। ঋণের দায়, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি এক জমিদারের লাইব্রেরি ঘরে বাস করতেন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই মধুকবি মারা যান।