প্রায়ই এই ফেসবুকের পক্ষে বিপক্ষে হয় নানা যুক্তি, তর্ক, আলোচনা-সমালোচনা।
মাসউদুর রহমান। পেশায় একজন সাংবাদিক। দুই বছর বয়সী ছেলে সূর্য বিন মাসউদের জন্য তিনি আগে ভাগেই একটি ফেইসবুক একাউন্ট খুলে রেখেছেন। ছেলের নানা মুহুর্তের ছবি ও ভিডিও নিয়মিত পোস্ট করেন সেখানে।
তিনি জানান, তার নিজের ছোটবেলার কোনো স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। ছেলের কোনো স্মৃতি যেন ফাঁক-ফোঁকরে হারিয়ে না যায় তাই তিনি একাউন্টটি খুলেছেন। সূর্য বুঝতে শিখলেই তাকে পাসওয়ার্ড বুঝিয়ে দেবেন।
বয়সের সাথে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। ‘দ্য ইন্টারনেট সোসাইটি বাংলাদেশ’ ২০১৫ সালে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৭ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর এবং ৪২ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর।
মানে কম বয়সী ফেইসবুক ব্যবহারকারীরর সংখ্যাও কম। কিন্তু সূর্যদের প্রজন্মই হয়তো প্রথম হবে, যাদের ফেইসবুক একাউন্টের মালিক হতে খুব বড় হতে হবে না।
জীবনের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে ফেইসবুক। দুই বছর আগের করা এই জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ ফেইসবুক ব্যবহার করেন। এ সংখ্যা যে আরও বেড়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
ফেইসবুকের মাধ্যমে আমাদের ভাবের বহি:প্রকাশ, মতাদর্শ আর চাওয়া পাওয়াগুলো ফুটে ওঠে। কেউ মাত্রাতিরিক্ত পোস্ট দিতে পছন্দ করেন কেউ বা সপ্তাহে একটি পোস্ট দেন। কারো পোস্টে ওঠে আসে গঠন মূলক সমালোচনা, কেউ বা আবার শুধু নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন।
এ নিয়েই ‘হ্যালোর’ সঙ্গে খোলামেলা কথা হয়েছে কিছু বন্ধুর।
রাকিব রায়হান রাফি। একটি রিয়েলিটি শো’র ক্ষুদে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্র সে। রাফি মনে করে বিনোদনের উদ্দেশ্যে সে ফেইসবুক একাউন্ট খুললেও একজন গায়ক হিসেবে যোগাযোগ এবং নিজেকে অন্যের সামনে উপস্থাপন করাটাই তার ফেইসবুকের ব্যবহারকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।
সে বলে, “আমি লাইক থেকে বেশি কমেন্ট প্রত্যাশা করি। আমাকে নিয়ে যদি কেউ সমালোচনা করে তাহলে সেখান থেকে নিজেকে শুধরানোর সুযোগ পাই।”
ক্ষুদে সাংবাদিক আমিনুর রহমান হৃদয়ের লক্ষ্য ভিন্ন হলেও ঘুরে ফিরে সেই একই ব্যাপার। ‘হ্যালোর’ ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছে সে। কৌতূহলেই ফেইসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল হৃদয়।
সে বলে, “কোথায় অন্যায় হচ্ছে, অসঙ্গতি ঘটছে তার খবর দ্রুত পেতে ফেইসবুকের বিকল্প নেই। এছাড়া জেলায় পরিচিতি পাওয়ারও একটি বিষয় আছে। কারণ আমার কাজ সাধারণ মানুষকে নিয়ে।"
পরিচিতির পরিমাণ 'লাইক' নির্ভর কি না তা জানতে চাইলে হৃদয় বলে, “লাইকের পরিমাণ বেশি মানেই পরিচিতিটাও বেশি, প্রচলিত অর্থে তাই মনে হয়। কিন্তু বিশ্লেষণে তা একদম ভুল। তবে লাইকের প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ নেই, তাও কিন্তু সঠিক নয়।”
এরপর কথা হয় সাজিদ হাসান শান্ত এবং আবিদা সুলতানা মুন্নি নামের দুই বন্ধুর সঙ্গে। দুজন ভিন্ন দুটি সংগঠনের সাথে জড়িত এবং ভিন্ন দুটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। শান্ত ধূমপান বিরোধী ক্যাম্পেইন করে এবং মুন্নি কাজ করে ব্লাড ডোনেশন নিয়ে। উভয়ের কাজই পরিচালিত হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে।
মুন্নি বলে, “সংগঠকদের অনেকেই গ্রুপের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য সমাজ সেবা করে থাকে। যেমন ব্লাডের প্রয়োজনে মানুষ লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ার করে। আর কাউকে সাহায্য করতে পারলে উচ্ছ্বাস তো থাকেই।"
সাধারণত বিনোদন আর যোগাযোগ কে কেন্দ্র করে আমরা ফেইসবুক একাউন্ট খুলি। তারপর একেক জন একেকভাবে নিজেকে পরিচিত করতে চাই। আর নেপথ্যে 'লাইক' পাওয়ার প্রতি আমাদের একটা আকর্ষণ তো রয়েছেই। এর জন্য আমরা ভিন্ন ভিন্ন পন্থাও অবলম্বন করি। লাইকের সাথে নিজের সুনাম,খ্যাতি,সম্মান আর মর্যাদার অর্থকেই বুঝি। যদিও এটা ভুল।
ফেইসবুক লাইকের প্রতি আমাদের এই তুমুল আকর্ষণের কারণ জানতে চেয়ে কথা হয় এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট নইমা আক্তারের সঙ্গে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “মানুষ একাত্মতার অনুভূতি ও নির্দিষ্ট সামাজিক সংযোগের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্যতা পেতে চায়।”
তিনি বলেন, “মানুষ যখন প্রত্যাশিত পরিমাণ লাইক পায়, তখন সে যথেষ্ট মনোযোগ পাওয়ার সন্তুষ্টি বোধ করে।"