প্রাচীন মহাকাশ ধারণা ও বিজ্ঞান

‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র জগৎ’ নামে একটি বই পড়তে পড়তে খুব অবাক হলাম। আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে কত আবিষ্কারের কথা জানি। কিন্তু প্রাচীন কালে এসব নিয়ে মানুষের কত অদ্ভুত সব ধারণা ছিল। যারা পড়নি, তাদের জন্য লিখে ফেললাম আমার জানা তথ্যগুলো।
প্রাচীন মহাকাশ ধারণা ও বিজ্ঞান

মহাকাশ নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হয় সভ্যতার শুরু থেকেই। মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগত, এখনও জাগে। আকাশের দিকে তাকালেই যে অসীম জগতের দেখা মেলে, সেখানে কী আছে? কারা আছে? মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত চাঁদের দিকে। কী শান্ত জোছনা! হীরে কণার মতো। মন ভরে উঠত। দিনে চাঁদ চলে গেলে রাতের অন্ধকার ভেদ করে ওঠত সূর্য। চাঁদ দিনে থাকে না কেন? চাঁদ-সূর্যের সম্পর্কই বা কী? এসব নিয়ে মনে মনে নিজের মতো করেই তারা ব্যাখ্যাও করত।

বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা তখনও ছিল অজানা। তাই যা চিন্তা করত তাই বিশ্বাস করত। প্রত্যেকের বিশ্বাস ছিল আলাদা আলাদা। কল্পনা ছিল সেগুলোর ভিত্তি। দিনের বেলায় সময় নির্ধারণ করত সূর্যের আলো দেখে। সূর্য যখন পৃথিবীর আড়ালে চলে গুহায় ফিরত মানুষ। আর রাতে চাঁদকে বানাত সময় পরিমাপের যন্ত্র। কালের আবর্তে এভাবেই চলছিল তাদের দিনরাত।   

পৃথিবী নিয়ে অনেকে ভাবত, বিশাল তিনটি তিমি মাছের উপর দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী। এরা সটান দাঁড়িয়ে থাকে, নড়ে না। তিমিগুলো যখন হঠাৎ নাড়া দিয়ে ওঠে, সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। বহু লোকের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীকে বহন করে আছে বাসুকি নামক বিশালাকৃতির একটা সাপ। যার আছে সাতটি ফণা। এর এক একটি ফণার উপর পৃথিবী থাকে এক এক সময়। যখন একটা ফণা ভর বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন পৃথিবীকে অন্য একটি ফণায় নিয়ে যায়। এই সরাবার সময় কেঁপে ওঠে জগৎ। তখন ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।

অনেকে ধারণা করত, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে মস্তবড় চারটি হাতির উপর। হাতিগুলো আবার বিরাট কচ্ছপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বিরাট প্রাণিগুলো যখন নড়ে তখনই ভূমিকম্পের উৎপাত হয়, এমন ধারণাও ছিল অনেকের মনে।  

কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। আমাদের ভূ-পৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট দিয়ে তৈরি। এই প্লেটগুলো একটি আরেকটি থেকে আলাদা, ফল্ট বা ফাটল দিয়ে। এই প্লেটগুলোর নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সব গলিত পদার্থ। কোনও প্রাকৃতিক কারণে এই গলিত পদার্থগুলোর নড়লে, প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থানচ্যুতি ঘটে। এ কারণে একটি প্লেটের কোনও অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায়, যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আবার অনেক সময় পাহাড় বা উঁচু জায়গা থেকে বড় শিলা পড়ার কারণেও ভূমিকম্প হয়ে থাকে ইত্যাদি।   

প্রাচীন ব্যাবলিয়নরা মনে করত, পৃথিবী একটা ফাঁপা পাহাড়ের মতো। এর ভেতরে আছে মৃতদের কালো জগত। খুব বড় এক সাগর পৃথিবীর ভর কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর চারদিকে ঘুরছে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র। শামুকের খোলসের মতো যার চারপাশ ঢাকা। পৃথিবীর ওপরে যেমন পানি, নিচেও তেমনি। ঝর্ণা বা ফোয়ারার মতো নিচ থেকে পানি ওঠে। ফাঁপানল চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে কুয়াশা। সৃষ্টি হয় বৃষ্টি। কিন্তু বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, পৃথিবীর জলীয়বাষ্প হালকা হয়ে ভূগর্ভ থেকে ওপরে উঠতে থাকে, পরে ধুলোবালির সঙ্গে মিশে জড়ো হয়ে সৃষ্টি করে মেঘ। মেঘ যখন আস্তে আস্তে ভারি হয় তখন মধ্যাকর্ষণের টানে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পড়ে বৃষ্টি হয়ে।

চন্দ্রগ্রহণ নিয়েও মানুষের মনে ছিল অদ্ভুত সব ধারণা। তারা মনে করত মাসের পনেরো তারিখে চাঁদের উপর আক্রমণ করে একটা হিংস্র শুকরী। তারপর চাঁদ  ধীরে ধীরে আলো নিভে যায়।

চীন দেশের লোকেরা ধারণা করত, একটা ড্রাগন প্রতি পনেরো তারিখে চাঁদকে গ্রাস করে ফেলে। এ কারণে চন্দ্রগ্রহণ হয়। হিন্দু পুরাণ মতে রাহু নামে এক অসুর চাঁদকে গিলে খায় বলে হয় চন্দ্রগ্রহণ।

এমন ধারণা বিজ্ঞান ভুল প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে যখন চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবী,  চাঁদ ও সূর্য একই সরল  রেখায় অবস্থান করে। পৃথিবীপৃষ্ঠের কোন দর্শকের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘটনাকে চন্দ্রগ্রহণ বলা হয়।’

হাজার বছর ধরে মানুষ এসব রহস্য খোঁজার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু যতদূর দৃষ্টি চলে সেটুকুর ভেতরেই ছিল প্রাচীনদের কল্পনা। এর বাইরে তারা যেতে পারত না। কিন্তু বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা এসব জানবার চেষ্টা করছেন যুগ যুগ ধরে।

এক সময় মহাকাশ নিয়ে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতবাদ মানুষের কাছে গ্রহণীয় হলো। কারণ, তার দেওয়া তথ্য কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারছিল না। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে, দুটো বস্তু একই সময়ে সমান উচ্চতা থেকে ছাড়লে ভারি বস্তুটি আগে মাটিতে পড়বে, আর হালকা জিনিসটি পরে মাটি স্পর্শ করবে। মহাকাশের কেন্দ্রস্থল পৃথিবী, এ রকম আরও অনেক কথা বিশ্বাস করত মানুষ।

অবশেষে ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও আবিষ্কার করেন টেলিস্কোপ। ভেঙে চুরমার করে দেন আগের সব ভ্রান্ত মতবাদ। মহাকাশ তখন মানুষের হাতের মুঠোয়। একের পর এক রহস্য ভেদ করতে থাকে বিজ্ঞান। মানুষ টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশকে খুঁজতে শুরু করে তন্নতন্ন করে।

গ্যালিলিও আবিষ্কার করেন, সূর্য নয়, পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চার পাশে। এই তত্ত্বের কারণে তাকে অনেক হেনস্থা করা হয়। তখন প্রাচীন জ্যোর্তিবিদদের যে ধারণা ছিল, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। গ্যালিলিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটান। মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

পরে বিজ্ঞানীরা বহু অজানা ও ভুল জানা জিনিসের রহস্য ভেদ করেন। এখনও করছেন। মানুষ এক সময় চাঁদ পর্যন্ত ঘুরে আসে। মঙ্গল নিয়ে চলছে গবেষণা। মহাশুন্যে স্টেশন তৈরি,  কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরিসহ আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে মানুষ।

বইটির লেখক মশিউর রহমান। যাদের আগ্রহ আছে পড়ে দেখতে পারো।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com