সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থী স্বল্পতা

“বেসরকারি স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিন্তু সরকারি স্কুলের পরিবেশ নোংরা৷ সরকারি স্কুলে কোনো গাইড নাই, তারা বাচ্চাদের কোনো খোঁজ নেয় না “
সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থী স্বল্পতা

রংপুর শহরের বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলগুলোর প্রাথমিক শাখায় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও সরকারি প্রাথমিকগুলোর বিভিন্ন শ্রেণিতে হাতে গোনা কয়েক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

সম্প্রতি রংপুরের ধাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। পঞ্চম শ্রেণিতে একটি শাখা এবং শিক্ষার্থী মাত্র ১৯ জন। অপরদিকে রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের পঞ্চম শ্রেণির জন্যই শাখা রয়েছে ১২টি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

জানা যায়, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে ১৩টি শাখা এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১২টি শাখা রয়েছে।

এছাড়া প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে ছয়শ নয় জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছয়শ ৪২ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ছয়শ পাঁচজন, চতুর্থ শ্রেণিতে ছয়শ ৩৫ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়শ ১২ জন। অপরদিকে ধাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাধাবল্লভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শ্রেণিতে একটি করে শাখা রয়েছে।

এদিকে ধাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে ১৮ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২২ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ২০ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৪ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ১৯ জন।

নগরীর রাধাবল্লভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও প্রায় একই চিত্র দেখা গেল।স্কুলটির প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে ২৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৩ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩২ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৫ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ২২ জন।

নগরীর আরেকটি বেসরকারি স্কুল পুলিশ লাইন্স স্কুল ও কলেজ। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পাঠদান শুরু হয়। সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে নয়টি করে শাখা এবং পঞ্চম শ্রেণিতে আটটি শাখা আছে। বিদ্যালয়টির তৃতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছয়শ ১৬, চতুর্থ শ্রেণিতে পাচশ ৭৮ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পাচশ ছয় জন শিক্ষার্থী আছে।

এ ব্যাপারে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

এক অভিভাবক কানিজ ফাতেমা (৪০) বলেন, “বেসরকারি স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিন্তু সরকারি স্কুলের পরিবেশ নোংরা৷ সরকারি স্কুলে কোনো গাইড নাই, তারা বাচ্চাদের কোনো খোঁজ নেয় না। কিন্তু বেসরকারি স্কুলে না আসলে তারা খোঁজ নেয় কেন বাচ্চাটা স্কুলে আসছে না। এজন্য বেসরকারি স্কুলে বেতন বেশি হলেও আমরা বেসরকারি স্কুলে বাচ্চাদের দিচ্ছি।”

শাকিলা আক্তার (৩৩) নামে আরেক অভিভাবক বলেন, “বেসরকারি স্কুলে তো শুধু টাকার খরচ, কিন্তু এখানে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হতে হয়। বেসরকারি স্কুলে বাচ্চাদের যত্ন নেয়, এজন্য খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমরা বেসরকারি স্কুলের প্রতি ঝুঁকি।”

কথা হয় রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের স্কুল শাখার উপাধ্যক্ষ মো. ফরহাদুজ্জামান সরকারের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “আমাদের স্কুলে জবাবদিহিতা রয়েছে। এখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শিক্ষাদান করেন। এছাড়া শিক্ষার পরিবেশ নিয়ম শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয় এ কারণে অভিভাবকরা আমাদের বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী প্রেরণ করেন। তাই আমাদের এখানে শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি থাকে।”

অভিভাবকরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের অভিযোগ আনলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলেন ভিন্ন কথা।

ধাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. ইমপিয়াজ চৌধুরী বলেন, “বেসরকারিতে যেমন জাকজমক ব্যবস্থা আছে সরকারিতে খুব কম দেখা যায়। প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে নিম্ন শ্রেণির বাচ্চারা। নিম্ন শ্রেণির বাচ্চাদের সাথে অনেকে উচ্চবিত্তরা তাদের বাচ্চাদের পড়াতে চায় না।”

রাধাবল্লভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা বেগম বলেন, "আমরা আমাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে সব চেষ্টা করি সঠিক ভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার। তবে এখানে কিছু সমস্যা আছে। তার মধ্যে দেখা যায় সরকারি অনেক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর পর্যাপ্ত উন্নয়ন হয় না।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ভালো পরিবেশ পায় না।অনেক সময় দেখা যায় শ্রেণিকক্ষে আসন সংখ্যার থেকে অনেক বেশি শিক্ষার্থী।আবার পর্যাপ্ত শিক্ষকও নেই আমাদের বিদ্যালয়ে।ফলে আমরাও শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার আনতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারি না।"

তিনি বলেন, "আর এখন কার অভিবাভকরাও চায় তার বাচ্চা টা ভালো পরিবেশে পড়াশোনা করুক। এই দিক থেকে কেজি স্কুল গুলো অনেক এগিয়ে। কারণ ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের মতো করে অবকাঠামোর উন্নয়ন করে, শিক্ষার্থীদের জন্য মনোরম পরিবেশ তৈরি করে। আর এজন্য এখন কেজি স্কুল গুলোতেই সন্তানদের দিয়ে থাকছে তাদের মা-বাবারা। কিন্তু ঐ স্কুলগুলোর শিক্ষক দের মানের থেকে সরকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা, মান অনেক ভালো বলে আমি মনে করি।"

তিনি আরও বলেন, "শুধু প্রাথমিকের শিক্ষকদের দোষারোপ করা যাবে না। আমাদের সরকারি বিদ্যালয় গুলোর মান আরও বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যালয় গুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।বিদ্যালয় পরিচালনা করতে পর্যাপ্ত যে জনবল প্রয়োজন তা নিয়োগ করতে হবে।তবেই একজন অভিভাবক নির্দ্বিধায় তার সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারবেন।"

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ এম শাহজাহান সিদ্দিক এর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “গ্রাম পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা যথেষ্ট শিক্ষার্থী পাচ্ছি। কিন্তু শহর এলাকায় আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে যে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে গরীব এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা লেখাপড়া করে। এজন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তারা তাদের সন্তানদের ভর্তি করায় না। এ কারণে শহর এলাকার পাবলিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে আর সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমে আসছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি অভিভাবকদের সচেতন করার জন্য যাতে তারা সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে তাদের সন্তান প্রেরণ করেন।”

প্রতিবেদকের বয়স: ১৪। জেলা: রংপুর।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com