আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়েছেন বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভিন। নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানো, পড়াশোনা, রাজনীতি, বাধা, চড়াই-উতরাইসহ তার নানা গল্প ওঠে এসেছে এই আলাপচারিতায়।
হ্যালো: আমরা শুনেছি আপনি নিজেই নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছিলেন? সেই গল্পটা শুনব আমরা।
রিজিয়া পারভিন: আমার নাম রিজিয়া পারভিন। আমি বর্তমানে বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। এছাড়া জেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বাগেরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।
আমার জন্মস্থান বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। আমি যখন প্রাথমিকে বা হাই স্কুলে পড়ি তখনও স্কুলের যাওয়ার রাস্তা পাকা হয়নি। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেতাম।
ক্লাস এইটে ওঠার পার আব্বা আমাকে প্রথম বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। হটাৎ একদিন তিনি বাজার থেকে এসেই বলেন কালকেই তোমার বিয়ে দেব। তোমার পাত্র রেডি। আমি তো শুনে আকাশ থেকে পড়েছি। তখন আমি নিরুপায় হয়ে আমার নানার কাছে যাই। তিনি একজন প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তার কথা আমার বাবা বা দাদা শুনতেন। আমি তখন তার কাছে খবরটা পাঠাই। আমার নানা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন। তিনি অনেক বকাঝকা করেন সবাইকে। তিনি বলেন, ‘তোমরা কেন বিয়ে দিতে চাও ওকে? প্রয়োজনে আমার নাতির সব খরচ আমি চালাব।’
তবে বাস্তবতা সেটা না। সামর্থ্য আমাদেরও ঠিকই ছিল। বিয়ে দেওয়ার মূল কারণ ছিল অসচেতনতা। আমাদের গ্রামে বাল্যবিয়ে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ছিল।
আমরা অনেক বড় পরিবার ছিলাম। আমরা একই ক্লাসে সাত বোন পড়তাম। তাদের মধ্যে তিন জনেরই এসএসসি পরীক্ষার আগে বিয়ে হয়ে যায়। বাকি তিন জনের এসএসসি পরীক্ষার পরেই বিয়ে হয়ে গেছে। আমিই একমাত্র ছিলাম বিয়ের আগে মাসটার্সটা শেষ করেছি, চাকরি করেছি তারপরে বিয়ে করেছি।
একটি দুঃখজনক বিষয় হলো আমি যখন খুলনাতে পড়াশোনা করতাম তখন বিয়ের অনেক প্রস্তাব আসত। আমি রাজি হতাম না, তখনই বাড়ি থেকে পড়াশোনার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিত।
আমি অনার্স, মাস্টার্স পড়াকালীন নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য পার্ট টাইম জব করেছি। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো আমার মেজ বোন আমার চেয়ে আট বছরের ছোট। যখন ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে তখন ওর বিয়ে হয়ে যায়। আমি সেই বিয়েটি বন্ধ করতে পারিনি। এটা আমাকে ওই সময় দারুণ ভাবে কষ্ট দিয়েছিল। আমার ছোটবোনেরও বাল্যবিয়ে ঠিক হয়েছিল আমি সেটা বন্ধ করি।
হ্যালো: ছোটবেলায় কী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
রিজিয়া পারভিন: ছোটবেলায় দেখেছি বাল্যবিয়ে, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন, পাশবিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির কথা শুনেছি। যেহেতু পশ্চাৎপদজনপদে আমার বেড়ে ওঠা, সেহেতু তখন থেকেই একটা বিষয়ই আমার মাথায় কাজ করত যে এই পরিবেশের বাইরে যেতে হবে। একটা কিছু করতে হবে।
হ্যালো: কীভাবে রাজনীতিতে আসলেন আপনি?
রিজিয়া পারভিন: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাধা অবশ্যই আছে। সবচেয়ে বড় বাধা হলো দৃষ্টি ভঙ্গি। বাংলাদেশে নারী পুরুষ সবাই সমান। তবে কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে নারীরা প্রথম শ্রেণির নাগরিক না তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে হয় পুরুষরা সরকারি দল আর নারীরা বিরোধী দল।
হ্যালো: নারী দিবসে বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
রিজিয়া পারভীন: এটাতো এক কথায় বলা মুশকিল। প্রতি বছরই নারী দিবসের কোনো না কোনো বিশেষ প্রতিপাদ্য থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমরা সারা বছরই নারীর অধিকার রক্ষায় কাজ করি তবে এই দিবসগুলো আমাদের আরও চাঙ্গা করে। পুরুষদেরকেও জানাতে হবে নারীর অধিকার সম্পর্কে। যত বেশি পুরুষরা নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে তত দ্রুত নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে নারীদেরকেও তার অধিকার রক্ষায় সচেতন হতে হবে। ঘরে-বাইরে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, দিনে-রাতে যেকোনো সময় আমরা নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ চাই।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: বাগেরহাট।