১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐতিহাসিক সেইদিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর নিকটতম ছাত্রকর্মী মহিব উল ইসলাম ইদু আন্দোলনের নানা স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন হ্যালোর সঙ্গে। গল্প করেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পার হওয়া দিনগুলোর।
হ্যালো: শুভেচ্ছা। প্রথমেই জানতে চাই কেমন আছেন আপনি?
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ এই তো ভালো। তুমি ভালো আছ?
হ্যালোঃ জ্বি আমিও ভালো। যেদিন আমাদের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলিত হলো ঠিক সেদিন থেকে গল্প শুনতে চাই। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার ভাবনাও শুনব।
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ, রেডিওতে খেলার ধারা বিবরণী চলছিল। হঠাৎ করে আনুমানিক বেলা ১১টা ১২ টার দিকে তা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর ঘোষণা দেওয়া হলো যে, প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন। ঐ ঘোষণায় আরও বলা হয়, আগামিকাল থেকে তথাকথিত পতাকা নিষিদ্ধ করা হলো এবং এই পতাকা বহনকারীকে দেখামাত্রই গুলি এবং যে ভবনে পতাকা উড়তে দেখা যাবে সেই ভবন ও তার আশেপাশের ১০০ গজ উড়িয়ে দেওয়া হবে।
অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে তাৎক্ষণিক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সেখান থেকে বেরিয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে কথা বলেন তিনি। সেখানে আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা সবাই ছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, “পাকিস্তানিরা আমাদের ক্ষমতা দিবে না। আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে।”
চলতে থাকে স্লোগান, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
বঙ্গবন্ধু বললেন, “থাম.. থাম.. আমি এখনি তোমাদের কিছু বলব না, তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
“আমি যা বলার ৭ মার্চ রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বলব।”
এরপর বিকেল ৩ টায় পল্টনে জনসভা। ওখানে যাব এবং দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য আমরা ফকিরাপুলে ‘হোটেল বাদশায়’ গেলাম। ঐ হোটেলে গিয়েই দেখা হলো আমার বন্ধু তৎকালীন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেনের সঙ্গে।
খাওয়া শেষে মিটিংয়ে আসলাম, সেখান থেকে তৎকালীন ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) গেলাম। ওখানে গিয়ে আমরা নিচে অবস্থান করি আর হাতে পোস্টার লেখা শুরু করি। জাহিদকে উপরে ডেকে নেওয়া হলো। ওখানে ছাত্রলীগের নিওক্লিয়াসের (উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি) মিটিং চলছিলো। এক ঘণ্টা পর জাহিদ নেমে আসল এবং আমাকে বলল, “চল আমাদের একটু যেতে হবে।”
তখন ছাত্রলীগের প্রধান কার্যালয় ছিল বলাকা ভবনের দু’তলায়, তো সেখানে গেলাম। যাওয়ার পর ছাত্র নেতা প্রয়াত রুমি ভাইকে পেলাম। উনি চা খাওয়ালেন এবং খবরের কাগজ মোড়ানো একটা প্যাকেট জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। ঢাকায় মানুষ সেদিন স্বঃতস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছিল। মৌচাক পর্যন্ত আসলাম, দেখলাম লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। সেখানে ছাত্রলীগের অনেক নেতাই ছিলেন। আমি ও জাহিদ পাকিস্তানের পতাকা পোড়ালাম। জাহিদ সেখানে সমবেত মানুষের উদ্দেশ্য বলল, “আমি একটা ঘোষণা করতে চাই, আমাদের এই প্রাণ প্রিয় পতাকা নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগামিকাল সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে এক বিক্ষোভ ও ছাত্র গণজামায়েতের আয়োজন করেছে।”
বলে রাখি, সেদিন রাতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। বাসায় ফেরার সময় জাহিদ বলল, “ দোস্ত, আমার উপর একটা গুরু দায়িত্ব পড়েছে। আগামিকালের মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র গণজমায়েতে এটা (কাগজে মোড়া প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল) নিয়ে যেতে হবে। তুই কি আমার সাথে থাকবি?”
২১-২২ বছরের তরুণ আমি। রাজি হয়ে গেলাম। কবি বলেছেন না, ‘যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’ বিষয়টা এমন ছিল। জাহিদ সেই প্যাকেটটা দিল আমার কাছে। বলল, “আজ তুই রাখ। কাল সকালে আমাদের নিয়ে যেতে হবে।”
রাতে তো এক্সাইটমেন্টের কারণে ঘুমই হয়নি। পতাকাটা আমি ও আমার ছোটবোন খুলে দেখলাম। আমার বোনও ইকবাল হলের ছাত্রলীগের কর্মী ছিল। পতাকাটা দেখে তো বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম। রাতটা পার করলাম।
হ্যালোঃ পরের দিন ২রা মার্চ। অর্থাৎ সেই ঐতিহাসিক দিন। একদম সকাল বেলা থেকে শুনতে চাই।
মহিব উল ইসলাম ইদুঃ সকালে ওঠে নাস্তাটা খেয়েই ৮টার দিকে বেরিয়ে গেলাম। মালিবাগ গুলবাগে রেললাইনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। জাহিদও সেখানে আসল। তখনতো বাঁশের লাঠি দিয়ে দোকানের ঝাপ উঠানো থাকত। ওখান থেকে একটা লাঠি নিয়ে পতাকাটা বাঁধলাম। এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ পতাকা দেখেই আমাদের ঘিরে ফেলেছে। ডাকতে হয়নি কাউকে। চারিদিকে স্লোগান শুরু হয়ে গেল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’
জাহিদ নগরের সাধারণ সম্পাদক আর আমি কর্মী। তাই আমি পতাকাটা বহন করে নিয়ে যাচ্ছি। আর জাহিদ স্লোগান দিচ্ছে, কাউসারসহ আরও অনেকে দিচ্ছে। রামপুরা রোড ধরে সিদ্ধেশ্বরী হয়ে আমরা যাচ্ছি। বর্তমান রাষ্ট্রীয় অতিথী ভবন ‘সুগন্ধা’ থেকে ৪০০-৫০০ গজ দূর থেকে দেখলাম যে, কিছু পাকিস্তানি সোলজার আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ। আবার সামনে তাকিয়ে দেখলাম অফিসার টাইপের একজন আর্মি আমাদের যাওয়ার জন্য হাতের রুমাল দিয়ে ইশারা দিলেন। আর যারা পথ আটকিয়েছিল তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। তখন মাথায় কাজ করছিল দেখা মাত্র গুলি করা হবে, যদি এখন করে দেয়! আমরা একটু ভড়কে গেলাম। তবে স্রোত ঠেলে পেছনে ফেরারও সুযোগ নাই। জনজোয়ার দেখে সাহস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তখন আমি স্লোগান ধরলাম, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশে স্বাধীন কর।’
আমার কাঁধে পতাকাটা। নব উদ্যোমে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স হয়ে টিএসসির সামনে গিয়ে পৌঁছলাম। নিষিদ্ধের কারণে ওখানে সমবেত কারো হাতে কোনো পতাকা ছিল না। চারদিক লোকে লোকারণ্য। মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি বিধায় জাহিদ ও আমাকে লোকজন একটু একটু করে রাস্তা পরিষ্কার করে দিল। আমরা দুজন কলাভবনে বানানো মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছলাম। সেই মঞ্চে ঢাকায় অবস্থানরত সব ছাত্র সংগঠনের ছাত্র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব। জাহিদ আমার কাছ থেকে পতাকাটা নিল। সে সামরিক কায়দায় রব ভাইয়ের হাতে পতাকাটা তুলে দিল। আমার কাছে মনে হলো, আমি বড় একটা কাজ করে ফেলেছি, হিমালয় জয় করেছি। তখন স্লোগান স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। সবাইকে স্লোগানে স্লোগানে থামিয়ে রব ভাই বললেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না, বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে। আমাদের মুক্তি আমাদেরই ছিনিয়ে আনতে হবে এবং তারা আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকা নিষিদ্ধ করেছে। আজ থেকে এটাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। (চলবে...)
প্রতিবেদকের বয়স: ১৭। জেলা: ঢাকা।(সাক্ষাৎকারটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত)।