নিজের নামের স্বার্থকতা রক্ষা করতেই যেন নেত্রকোণার কিশোরীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন কল্যাণী হাসান নামের এক নারী। বাল্যবিয়ে বন্ধ, নারীদের সাবলম্বী করাসহ সর্বোপরি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছেন তিনি। গত কয়েক বছরে নিজের চেষ্টায় ৬৮টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলা সদরের দিঘদাইর গ্রামের বাসিন্দা কল্যাণীর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিয়ে ঠিক হয়। নিজের বিয়ে বন্ধ করে সিদ্ধান্ত নেন বড় হয়ে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম, স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন কল্যাণী হাসান।
হ্যালো: আমরা জানি আপনি অনেক দিন থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করছেন। কেন মনে হলো যে আমাকেই এই কাজটা করতে হবে?
কল্যাণী হাসান: আমি অনেক বছর ধরে বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করছি। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই কঠিন পরিস্থিতি থেকে সে সময় আমি নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম বলে আজকে তুমি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছ। আমি আজকে প্রতিষ্ঠিত, সমাজে আমি এটা নিয়ে কথা বলতে পারছি। এই প্রতিষ্ঠার জন্যই বাল্যবিয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর সে জন্য কাজটা তো কাউকে না কাউকে করতেই হয়; আমিও যেহেতু ভুক্তভোগী সেই জন্য আমিই দায়িত্বটা নিয়েছি।
হ্যালো: এই যে এতদিন ধরে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য কাজ করছেন, এতে নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক পরিবারের রোষানলে পড়তে হয়েছে।
কল্যাণী হাসান: রোষানলে তো অনেক পড়তে হয়। একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। দুই পক্ষ মিলে অনেক কাজ টাজ শুরু করে দেয়, সেক্ষেত্রে আমরা গিয়ে হঠাৎ একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি, বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়। রোষানলে তো এমনিতে পড়েই যাই। এছাড়া আমি তো গহনার ব্যবসা করি। অনেক লোক আমার দোকানে গহনা বানাতে আসে না, যাদের বাল্যবিয়ে থাকে তারা তো আসতেই চায় না। তারা ভাবে এই মহিলা জানলে এই বিয়েটা বন্ধ করে দেবে।
অনেক জনপ্রতিনিধিরাও অনেক জায়গায় বসে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা করে। অবার অনেকে বাল্যবিয়ের কথা শুনলে বলে ঐ কল্যাণী জানলে বিয়েটা আর হবে না। যেহেতু একটা কাজে বেরিয়েছি মানুষের কথা শুনলে তো আর হবে না। আমি আমার কাজ করেই যাই।
হ্যালো: মহামারিতে অনেক বাল্যবিয়ে হয়েছে সে সময়টায় কীভাবে সামলেছেন?
কল্যাণী হাসান: সেই সময়ে তো তোমরা জানোই কেন্দুয়া উপজেলায় অসহায় মানুষদের যারা কাজ করতে পারে নাই মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত তাদেরকে আমরা খাদ্য সহায়তা দিয়েছিলাম।সেই কাজ করতে গিয়েই আমরা জানতে পারতাম কোন জায়গায় বাল্যবিয়ে হবে। এরকম যেগুলা জানতে পারতাম তাদেরকে বুঝিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে অনেক সময় ভয়-ভীতি দেখিয়ে আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করতাম। সেই সমইয়েও আমরা ঘরে বসে থাকি নাই।বাল্যবিয়ে বন্ধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
হ্যালো: আমরা যতদূর জানতে পেরেছি আপনারা বিয়ে বন্ধ করার পর পরিবারের লোকজন আবার চুপিচুপি বিয়ে দিয়ে দেন, তখন আপনাদের ভূমিকা কী হয়?
কল্যাণী হাসান: আমাদের বাল্যবিয়ে বন্ধের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এটা। আমরা প্রথম কাজটা করে এসে যে সার্থকতাটা ফিল করি কিন্তু পরক্ষণেই যখন শোনা যায় যে চুপি চুপি অন্য জায়গায় নিয়ে বিয়েটা হয়ে গেছে আসলে আমরা খুব কষ্ট পাই। সেই ক্ষেত্রেও আমরা কাউন্সেলিংটা জোরদার করি। তাদের বোঝাই আপনারা যে কাজটা করছেন এই কাজটা করা অন্যায়, আচ্ছা যাই হয়ে গেছে ফার্দার কাজটা যেন এমন না হয়। অন্য কোনো পরিবার যেন একটা দেখ সিদ্ধান্ত নিতে না পারে সেক্ষেত্রে আমরা জোর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি।
হ্যালো: আনেক বাবা মা কন্যা সন্তানদের একটু বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দিতে চান, এমতাবস্থায় মেয়েদের করণীয় কী? বা কী করলে তারা বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে?
কল্যাণী হাসান: নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা মেয়েদেরকে নিজের বোঝা মনে করে, যে মেয়েটার ১২/১৩ বছর হয়ে গেছে সে মেয়েটারে বিয়ে দিলে আমার বোঝা কমে যায়।কিন্তু বাল্যবিয়ে একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। ফুটে ওঠার আগেই যে ফুল ঝরে যায়, সে ফুলটার ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। ঠিক তেমনি বাল্যবিয়েটা মেয়েদের জন্য এরকম। প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত নিজেকে সচেতন রাখা, পড়াশোনার সুযোগ দিচ্ছে সরকার, পড়াশোনা করা। এখন মেট্রিক পর্যন্ত উপবৃত্তি দিচ্ছে, বই দিচ্ছে এরপরেও উপরের লেভেলেও এগুলা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কলেজ লেভেলেও শতভাগ উপবৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে এখন। অভিভাবকেরা মেয়েদের যেন বোঝা মনে না করেন সে জন্য সরকার যুব উন্নয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেনিং করার ব্যবস্থা করেছে, সেই ট্রেনিংয়ের তাদেরকে মাসিক টাকাও দিচ্ছে। সেই ট্রেনিংকে যেন তারা বাস্তবে কাজে লাগাতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও দিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগগুলো মেয়েদের কাজে লাগাতে হবে।আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে নেত্রকোণার নারীদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বিউটিফিকেশন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বাঁশ বেত দিয়ে সৌখিন জিনিস বানানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
আমার কী করা উচিত, আমি কী করতে পারি- এই যে বিষয়টা আমরা যদি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ছোট ছোট মেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারি তাহলে বাল্যবিয়ে নিয়ে আমাদের আর চিন্তা করতে হবে না।
আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধে অভিভাবক ও কিশোরীদেরকে কাউন্সেলিং করব। সকলের কাছে আমি আহ্বান করব তারা যেন নিজ নিজ জায়গা থেকে নারীদেরকে কাউন্সেলিং করে। কিশোরীদের বোঝাতে হবে এই সমাজটা তাদের, এই দেশটা তাদের, এদেশের কাজে সমাজের কাজে তাদের নিয়োজিত হতে হবে।
প্রতিবেদকের বয়স: ১২। জেলা: নেত্রকোণা।