আমার প্রথম হিমালয় দেখা

ডিসেম্বর মানেই ছুটির সময়, বেড়ানোর সময়। প্রতি ডিসেম্বরেই তাই এদিক সেদিক বেড়াতে যাওয়া হয় আমার। 
আমার প্রথম হিমালয় দেখা

এবারের ডিসেম্বর মাস যদিও ছুটির ছিল না, সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। তারপরও দীর্ঘ সময় ঘরে বন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বলে কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে পরিবারসহ বেরিয়ে পড়ি। 

আমাদের গন্তব্য হিমালয় কন্যা নেপাল। ২৭ ডিসেম্বর সকাল দশটায় ছিল ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু ফ্লাইট। বলতে গেলে সময় মতোই ঢাকা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু পথে বেঁধে যায় বিপত্তি। বিমানের পাখার সাথে পাখির সংঘর্ষ হওয়ায় আবারও ফিরতে হয় ঢাকাতেই। 

প্রায় ৪৫ মিনিট ঘুরে আবারও ঢাকায় জরুরি অবতরণ করতে হয়। যাত্রীদের সবাইকে ট্রানজিট লাউঞ্জে বসিয়ে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করতে থাকে। সেখানেই দুপুরের খাবার সেরে ফেলি আমরা। বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় স্বস্তি ছিল, কিন্তু আদৌ কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তাও ছিল!

অবশেষে বিকাল ৫টার দিকে অন্য একটি বিমানে একই ক্রুদের নিয়ে আবারও আমরা কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। এবার ঠিকঠাকভাবে অবতরণের পর বিমানবন্দরের কাজকর্ম শুরু। কোভিড রিপোর্ট যাচাই, এন্টিজেন টেস্ট, অন এরাইভাল ভিসা ফরম পূরণ, ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ ফর্মালিটি পূরণ করে নেপালের স্থানীয় সময় রাত ৮টায় বিমানবন্দর থেকে বের হই আমরা। 

বাইরে আমাদের জন্য দুপুর থেকেই ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। গাড়ি নিয়ে সে সময়ই নাগরকোটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু খুবই বিপদজনক রাস্তা দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ চলার পর পৌঁছাই আমাদের রিসোর্টে। 

যাওয়ার পথে কাঠমান্ডু শহর পুরোটাই দেখা যাচ্ছিল। শহরের আলোগুলো যেন তারার মত জ্বলছিল। গাড়ি থেকে নামার পরই বোঝা যায় বাংলাদেশের সাথে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্য। হিমেল বাতাসে গায়ে কাপুঁনি উঠে যাচ্ছিল। ক্লান্ত থাকায় রুমে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। 

পরদিন কাকতালীয়ভাবে ভোর সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে ঘরের ব্যালকনিতে চলে যাই, জানালার পর্দাও সরিয়ে দেই। তখনও কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা। হালকা আলো দেখা যাচ্ছিল। 

দশ মিনিট পর সূর্য উঠতে শুরু করে, তার আগেই হিমালয়ের অংশগুলো অল্প অল্প দেখা যাচ্ছিল। সূর্য কিছুটা উঠতেই অন্নপূর্ণা রেঞ্জের চূড়ায় সোনালী আভার দেখা মেলে, সত্যিকার অর্থে অপরূপ দৃশ্য সেটি। ক্যামেরায় সে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় না, শুধুই চোখ দিয়ে দেখা যায়। 

সূর্য ওঠার পর ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করে নিই আমরা। রিসোর্টের রেস্টুরেন্টের কোণায় বসে হিমালয় দেখতে দেখতে খাবার খেয়ে নিই। তারপর আরো কিছুক্ষণ হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে রওনা হই ভক্তপুরের উদ্দেশ্যে। নেপালে যখন রাজতন্ত্র ছিল তখনকার রাজাদের বসবাসের বাড়িগুলো দরবার স্কয়ার বলে পরিচিত। সে জায়গাটিই ভক্তপুর নামে পরিচিত। তিনটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত জায়গাটি ঘুরে দেখা মেলে প্রাচীন কারুকার্যময় বাড়িঘর, বড় বড় পানির কুয়া, মন্দির এবং পাঠাগারের। 

দরবার স্কয়ারে ঘুরাঘুরি শেষে রওনা হই চন্দ্রগিরির উদ্দেশ্যে। দেড় ঘণ্টার মত যাত্রা শেষে চন্দ্রগিরি নেমে সোজা কেবল কারের টিকেট করে ফেলি। প্রায় বিশ মিনিট কেবল কারের রোমহর্ষক যাত্রা শেষে পৌঁছে যাই চন্দ্রগিরি পর্বতের চূড়ায়। সেখান থেকে হিমালয়ের ১৩টি রেঞ্জ স্পষ্ট দেখা যায়, মাউন্ট এভারেস্টেরও দেখা মেলে। 

হালকা মেঘ থাকায় এভারেস্ট দেখা না গেলেও ৫-৬ টি রেঞ্জ স্পষ্টভাবে দেখতে পেরেছি আমরা। সেখানে বোর্ড থেকে জানতে পারি সমুদ্র থেকে ৮৪০০ ফুটের মতো উচ্চতায় আছি আমরা। ব্যাপারটার প্রমাণও পাওয়া যায় যখন মাত্র দুই মিনিট হেঁটেই প্রচণ্ড হাপিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে চন্দ্রগীরি থেকে যে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখেছি তার তুলনা করা সম্ভব নয়।

সন্ধ্যা পর্যন্ত চন্দ্রগীরিতে ঘুরে কাঠমান্ডু ফিরে আসি। পরদিন ভোরে পোখারার বাস। তাই দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ি। 

পরদিন ভোরবেলা পোখারার বাস ধরতে উঠে পড়ি। উঠেই দেখি প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এতে কিছুটা মন খারাপ লাগে। বৃষ্টির কারণে শীতও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল, সাথে সৌন্দর্যও। মেঘের ভেতর দিয়েই যেন গাড়ি চলছিল, আর ওপরের পাহাড়গুলোতে জমাট বাঁধা মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে ফেলতে পারব। আর পাথুরে নদীর প্রচণ্ড শব্দে তো চারপাশ ঝমঝম করছিল।

পাহাড়ি অত্যন্ত বিপদজনক রাস্তা ধরে প্রায় ৮ ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছাই পোখারা। সেদিন বেশি কিছু করা যায় না, বৃষ্টির মধ্যে পোখারার রাস্তায় নেমে খাবার সেরে দ্রুতই আবার হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে যাই। 

পরদিন ভোরে উঠে দেখি সমস্ত মেঘ গায়েব, রোদ ঝকঝক করছে। এদিন পোখারার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার পালা। প্রথমে সেটি নদীতে চলে যাই। যদিও নদী থেকে অনেক উপরে ভিউ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। তবে নদীর পানি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ রাখা ছিল। নদীর বয়ে চলার শব্দ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তারপর আন্তর্জাতিক মাউন্টেইন জাদুঘরে গিয়ে দারুণ লাগে।

নেপালের ঐতিহ্য এবং হিমালয় নিয়ে দারুণ সব তথ্য ব্যবহারিক রূপে জানতে পারি। এরপর পাশাপাশি ডেভিস ফল ঝর্না আর গুপ্তেশর গুহায় ঘুরে দেখি, দুটোই রহস্যময় এবং কিছুটা বিপদজনক জায়গা। সেখান থেকেই টুকটাক কেনাকাটা আর খাওয়াদাওয়া হয়। তবে এদিনের ঘোরাঘুরির মাঝেও আমার মন বারবার যাচ্ছিল তুলার মত মেঘের পেছন থেকে উঁকি মারতে থাকা হিমালয়ের দিকে। 

পরের দিন অনেক ভোরে উঠেই চলে যাই সারাংকোট। যাওয়ার আগে ধারণা ছিল না জায়গাটা এমন সুন্দর।

নেপালের এই ভ্রমণটা আমার জন্য অনেক স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ এই প্রথমবার হিমালয়কে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com