মায়ের কপালের লাল সিঁদুরই যেন তাকে রোষানলে ফেলেছে। অনেকে ভালো মন্তব্য করেছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মা ছেলেকে। কিন্তু বিপত্তিটা তৈরি করে আরেকদল মানুষ। কটুক্তি আর ভার্চুয়াল আক্রমণে এই অভিনেতাকে অপদস্ত করতে শুরু করেন।
কেউ কমেন্ট করেছেন চঞ্চল চৌধুরী যে হিন্দু এটা মানতে পারছেন না। কেউ একজন লিখেছেন, “মুসলমান হিসেবে সাপোর্ট করতাম আজ থেকে আর পারছি না।”
এরকম সাইবার আক্রমণ এটাই প্রথম নয়। বাংলাদেশের জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটারকেও পড়তে হয়েছিল এমন আক্রোশের মুখে।
তার মানে কী জাতিগতভাবেই আমরা সাম্প্রদায়িক এবং অসহিষ্ণু? আমাদের ইতিহাস তো তা বলে না। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশ ভাগ করা হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে। এই তত্ত্বটি হলো দুটি জাতির জন্য আলাদা আলাদা ফরমুলা। হিন্দু ও মুসলমান এক নয় সেই ধারনা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকেই এমন তত্বের উদ্ভব হয়েছিল।
এই ফরমুলা দিয়ে দেশ ভাগ করা হলেও বাংলাদেশ যে এটা মেনে নেয়নি তা ১৯৭১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। অসাম্প্রদায়িকতার নীতিতে হওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করে দেয় দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাড়তা। অর্থাৎ আমাদের দেশ জন্ম থেকেই সাম্প্রদায়িক বিষ বর্জন করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূল নীতির একটি হলো অসাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁতকে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ উপড়ে ফেলে দিয়ে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ।
সেই দেশের গর্বিত নাগরিক আমরা। আর আমাদের অসাম্প্রদায়িক দেশে ঘটে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা। যা মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কষ্টকর।
চঞ্চল চৌধুরী ওই সাইবার আক্রমণের পর জবাব দিয়েছেন। তিনি মানুষ, তিনি শিল্পী এটাই তার বড় পরিচয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলিম। তাহলে আগে কোন পরিচয়ে আমরা পরিচিত? নিশ্চয়ই মানুষ পরিচয়ে।
চঞ্চল চৌধুরীর সাথে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার পর বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসটি যেমন মনে পড়ল, পাশাপাশি আমার পাঠ্যবইয়ের একটি কবিতাও বার বার মাথায় আসছে।
আমি রাজধানীর মাইলস্টোন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতাটি একাদশ শ্রেণিতে আমি প্রথম পড়ি। শ্রেণি শিক্ষক কবিতাটি যত বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আমার মন তত ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
জাতীয় কবি লিখেছেন,
"তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।"
শেষে তিনি লিখেছেন,
"মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।"
ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাত এগুলো কারো প্রধান পরিচয় নয়। সবার উপরে মানুষ সত্য। আমাদের বায়োলজিক্যাল এই পরিচয়টিই সবচেয়ে বড় পরিচয়। প্রাথমিক থেকেই স্কুলে পড়ানো হয়েছে এটা। মুখস্ত করেছি এই বুলি কিন্তু কখনো ধারণ করিনি। আজ বুঝি এই লাইনটা কত ভারি, কত শান্তি বহন করে।
আমি ভারতেশ্বরী হোমসে পড়েছি। এটি একটি বিশেষায়িত আাবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি জিনিসটা আমি পোক্তভাবে শেখার সুযোগ পেয়েছি। তাই এখন ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো মেনে নিতে কষ্ট হয় আমার।
আমাদের দেশের একজন তারকা যখন সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হন তখন এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জা। তাকে আমরা একজন শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছি৷ তিনি অসাধারণ গান করেন। তার কর্ম পরিচয়ে তাকে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।
এ ঘটনার পর তিনিও একটি কবিতা আবৃত্তি করে নিজের ফেইসবুক দেয়ালে পোস্ট করেছেন। কবিতার ছন্দে ছন্দে মানবতার মন্ত্র তুলে ধরে চঞ্চল চৌধুরী বলেছেন,
"ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, মানুষ নিয়ে নয়,
এমনই করে সভ্যতা শেষ, হচ্ছ তুমি ক্ষয়।
ধর্ম রক্ষের ঝাণ্ডা তোমায় কে দিয়েছে ভাই,
ধর্ম নিয়ে ব্যবসা কর, জ্ঞান কী তোমার নাই?
সব ধর্মই এক কথা কয়, মানুষ সেবা কর,
ধর্মের নামে ব্যবসা করে ভাবছ তুমি বড়…।"
এই বার্তাগুলো আমরা লালন করতে শিখলে আমরাও সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।